বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো জানিয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে ৩ হাজার ৪৮৩ জন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি আছে। রেকর্ড ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংক খাতের অবস্থা এখন খুবই নাজুক।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের শেষে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায়। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ব্যাংক খাতে আরও ধস নামবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, “ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের টাকা দেশে নেই। সব বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশে ফেরার আশা খুব কম। দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের বিচারের আওতায় আনুন। কোনো আপিলের সুযোগ রাখা যাবে না। অথবা হাইকোর্টে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত বিচার করুন। দীর্ঘদিন মামলা ঝুলিয়ে রাখা চলবে না।”
তথ্য থেকে জানা যায়, কয়েক দশক ধরে প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিয়েছেন, কিন্তু তা খেলাপি দেখানো হয়নি। এখন এই তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। ২০২৫ সালের জুনে মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকায়। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাত্র এক বছরে তিনগুণ বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে মার্জার বা একীভূত করার কাজ প্রায় চূড়ান্ত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চক্র ব্যাংককে বিপর্যয়ের মুখে ফেলায় তারল্য সংকট বাড়ছে। নতুন ঋণ বিতরণ কঠিন হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও উচ্চ সুদের চাপে পড়ছেন, কিন্তু খেলাপিরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে, আমানতকারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। শেখ হাসিনার সময়ে বহু নামে-বেনামে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, যা গোপন রাখা হয়েছিল। এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঘোষণার সময়সীমা ছয় মাস থেকে তিন মাসে নামানো হয়েছে। কৃষি ও এসএমই ঋণে বিশেষ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক ব্যবসায়ী বিপুল ঋণ নিয়েও তা বিদেশে পাচার করেছেন। অন্যদিকে যারা তখন ব্যবসা করতে পারেননি, তারা এখনো খেলাপির খাত থেকে মুক্ত নন। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’ বলছেন। আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক প্রান্তিকে ব্যবসা সচল হলে খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৪৫ শতাংশ খেলাপি ছিল। ডিসেম্বর মাসে তা ছিল ৪২.৮৩ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ডিসেম্বর মাসে ছিল ১৫.৬০ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা অভিযোগ করছেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মে বিপুল ঋণ নিয়েছেন, যার বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে।
এসআইবিএলের সাবেক এমডি শফিকুর রহমান বলেন, “তথ্য নয়, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করুন। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। নয়তো শুধু তথ্য সংরক্ষণ করলে লাভ হবে না।” জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম ও নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ঋণের এমন বৃদ্ধি অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি করেছে। নতুন ঋণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাত ও ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পেয়ে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে।