দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের হঠাৎ চড়া সুদহারে বেকায়দায় পড়েছেন। ছোট, মাঝারি ও বড় খাতের বিনিয়োগকারীরা মুনাফা দিয়ে নিয়মিত ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছেন না। অতিরিক্ত সুদ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে রপ্তানি খাতের নতুন কারখানাগুলোও ঝুঁকির মুখে। খরচ কমাতে কিছু ব্যবসায়ী কর্মী ছাঁটাই করছেন এবং উৎপাদনের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি জানান, বর্তমানে ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব নয়। দেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, মূল্যস্ফীতি অন্তত পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে নামলে তখন ঋণের সুদহারও কমতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ এবং চলমান মূল্যস্ফীতির জটিলতায় পড়েছেন। সম্প্রতি সুদহার বাড়ানো হলেও এর সুফল খুব বেশি দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.২৯ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৮.৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি এখনও উচ্চ স্তরে রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু মূল্যস্ফীতির কথা দেখিয়ে সুদ বাড়ালে কেউ ব্যবসা চালাতে পারবে না। আবার এভাবে সুদহারের চাপ আর্থিক খাতে নতুন বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের (সিএসপিএস) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, মূলত দাতা সংস্থার পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিসূদহার বাড়ায়। দাতারা যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের অর্থনীতি দেখেন, তা প্রায়শই উল্টো ফল দেয়।
ড. মিজানুরের মতে, এভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের ফাঁদে ফেলে দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের আয়ের উৎসে পরিণত করা হয়। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতি বেশি নির্ভরশীল হলে এই প্রভাব আরও বড় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য চাপ তৈরি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট শেষে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২.১৫ শতাংশ। ব্যাংকভেদে এটি ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত ছিল।
এ তুলনায় ২০২৪ সালের আগস্টে গড় সুদহার ছিল ১১.৫৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের একই সময়ে এটি ৭.১৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৭.১১ শতাংশে ছিল। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের মধ্যে সুদহার দ্বিগুণের মতো বেড়েছে। খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্টে সবচেয়ে বেশি সুদ ছিল এসএমই খাতে। এ খাতে গড় ঋণ সুদহার ছিল ১২.৫৪ শতাংশ। এরপর বৃহৎ শিল্পে সুদ ১২.৫১ শতাংশ এবং কৃষি খাতে ১১.৭৩ শতাংশে ছিল। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণের চড়া সুদ এবং চলমান মূল্যস্ফীতি একসাথে ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ছোট ও মাঝারি ব্যবসা এটি মুনাফা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। চলতি বছরের আগস্টে সবচেয়ে বেশি ঋণের সুদ নিয়েছে দুর্বল পদ্মা ব্যাংক। ওই মাসে ব্যাংকটির গড় সুদহার ছিল ১৬.২২ শতাংশ। অন্যান্য ব্যাংকের সুদহার ছিল যথাক্রমে:
- সিটিজেন ব্যাংক: ১৫.১৭ শতাংশ
- ন্যাশনাল ব্যাংক: ১৫.০১ শতাংশ
- বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক: ১৪.৫২ শতাংশ
- কমিউনিটি ব্যাংক ও এনআরবি ব্যাংক: ১৪.৪১ শতাংশ
- মধুমতি ব্যাংক: ১৪.১৬ শতাংশ
- মেঘনা ব্যাংক: ১৪.১৪ শতাংশ
এছাড়া, আল-আরাফাহ, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আইএফআইসি, যমুনা, মার্কেন্টাইল, এনআরবিসি, ওয়ান ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের নিচে সুদ বা মুনাফা নিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুদহার এইভাবে বৈষম্যমূলক থাকলে ব্যবসায়ীরা ঋণ গ্রহণে সতর্ক হচ্ছে এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য চাপ বাড়ছে।
উচ্চ ব্যাংক সুদের কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণও তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.৩৫ শতাংশে, যা ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তুলনামূলকভাবে, জুলাইতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৫২ শতাংশ, জুনে ৬.৪৯ শতাংশ। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৮২ শতাংশে নেমেছিল। করোনার সময়ও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশের ওপর ছিল। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.১৩ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের জুনে ৯.৪৮ শতাংশ।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার আরেকটি সূচক হলো মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ২৬৪ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৬২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৭২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণের চড়া সুদ এবং সীমিত বিনিয়োগের কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্প খাতের ক্রিয়াশীলতা কমছে। এ পরিস্থিতি চললে দেশের অর্থনীতিতে স্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে। উচ্চ ব্যাংক সুদের কারণে দেশের গার্মেন্টস খাতেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৪.৫ শতাংশে উঠার পর খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, উৎপাদন খরচ গড়ে ১.৪ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
নোমান গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার সিফাত হোসেন ফাহিম বলেন, তাদের উৎপাদন খরচ গত এক বছরে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর পেছনে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং ব্যাংক ঋণের অতিরিক্ত চাপ মূল কারণ। তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতির পুরো দায় বিগত দেড় দশকে আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা এবং দাতা সংস্থার বিভিন্ন পরামর্শের ওপর পড়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও গার্মেন্টস উদ্যোক্তা মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, শুধুমাত্র ঋণের চড়া সুদের কারণে প্রতি পাঁচ ডলারের রপ্তানিতে প্রায় ৭ থেকে ১০ সেন্ট অতিরিক্ত খরচ যোগ হয়েছে। যদিও একক পণ্যে খরচ কম মনে হলেও মিলিয়ন পিস উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি বড় প্রভাব ফেলে। তিনি আরও বলেন, অনেক গার্মেন্টস কারখানা তাদের কার্যক্রম চালাতে ঋণের ওপর নির্ভরশীল। এই ঋণের টাকায় কাঁচামাল যেমন তুলা, কাপড় ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী আমদানি, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ এবং যন্ত্রপাতি কেনা বা কারখানা সম্প্রসারণের খরচ মেটানো হয়। স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণ বা কার্যকরী মূলধনের ঋণ থেকে এই ব্যয় সাধারণত আসে। তাই সুদের হার বাড়লেই উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, সরকার বিনিয়োগবান্ধব সিদ্ধান্তে হেঁটে চলছে না। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, বিগত দেড় দশকে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই বর্তমান সরকার কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত উদ্যোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, যেসব বড় কেলেঙ্কারি আর্থিক খাতে হয়েছে, তার কোনোটির বিচার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। আর যারা পালিয়ে যাননি তাদের ওপর ব্যাংকগুলো বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করছে।
জিয়াউর রহমান আরও বলেন, সরকারকে এখন দরকার ছিল নীতি সহায়তা বাড়িয়ে আর্থিক খাতকে সচল করা কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানো হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে, এবং বন্দরে কয়েকগুণ শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সব পদক্ষেপ মোটেও বিনিয়োগবান্ধব নয়। এর ফলে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশ আমদানির পরিকল্পনা স্থগিত বা বাতিল করেছে।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যবসার মুনাফা সর্বোচ্চ ১০–১১ শতাংশ হলেও ব্যাংক ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে ১৪ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ। ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) জানিয়েছে, এতে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত পুঁজি সুদ দিতে খরচ হচ্ছে। এমতাবস্থায় তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে সুদহার এক অঙ্কে নামানোর দাবি জানিয়েছেন। উচ্চ সুদের প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগেও পড়ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চড়া সুদের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল–জুন) এফডিআই প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৬২ শতাংশ কমেছে। যদিও প্রথম প্রান্তিকে আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল, দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিনিয়োগ হঠাৎ করে পতনেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, কিছু ব্যাংক অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে ভুগছে। সংকট কাটাতে এসব ব্যাংক চড়া সুদহারে আমানত সংগ্রহ করছে। ফলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিক সুদ চার্জ করা হচ্ছে। এছাড়া কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলো আরও বেশি সুদ নিচ্ছে। এ কারণেই ব্যাংক ঋণের সুদ হার ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে দেশের প্রধান প্রতিযোগী হলো পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও চীন। ব্যাংক ঋণের সুদহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ। উদাহরণস্বরূপ: পাকিস্তান: গড় সুদ ৮.৫ শতাংশ, ভারত: ৯–১২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা: ১৩ শতাংশ, ভিয়েতনাম: ৬–৭ শতাংশ অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ব্যাংক ঋণের এই চড়া সুদ দীর্ঘমেয়াদি থাকলে উদ্যোক্তাদের অনেককে পথে বসতে হবে। নতুন বিনিয়োগও আসবে না, যা চাকরির বাজারে আরও মন্দার সৃষ্টি করতে পারে।

