সিটিব্যাংকের সিইও জেন ফ্রেজার যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংকের রিটেল ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ করা। একই পথে এগিয়েছে এইচএসবিসি। বাংলাদেশসহ ইন্দোনেশিয়া মতো বাজারে তাদের সাম্প্রতিক রিটেল ব্যাংকিং বন্ধের পদক্ষেপ এ কথাই প্রমাণ করে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো বুঝতে পেরেছে, রিটেল ব্যাংকিংয়ের খরচ অনেক বেশি, মূলধন বেশি লাগে এবং লাভের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। উদাহরণস্বরূপ, জে.পি. মরগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে রিটেল ব্যাংকিং সেবা দেয় না। ডিজিটাল ব্যাংকিং কতটা এগিয়েও গেল, তবুও রিটেল কার্যক্রমের জন্য অবকাঠামো বজায় রাখা বিশাল ব্যয়। তাই অনেক আন্তর্জাতিক ব্যাংক এখন ধনী গ্রাহকদের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে—ফি, বিনিয়োগ পণ্য এবং ক্রস-সেলিংয়ের মাধ্যমে বেশি আয় করার লক্ষ্য নিয়ে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কেন এখনও ব্যাংকগুলো রিটেল ব্যাংকিংকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে, শাখা বাড়ানো অব্যাহত রেখেও? ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাংকিং যুগে, বেশিরভাগ গ্রাহক শাখায় না গিয়ে প্রায় সব লেনদেন করতে পারে। বিশেষ করে শহুরে এলাকায় কাজ করা ব্যাংকগুলোর জন্য ধনী গ্রাহক কেন্দ্রিক সেবা বা সম্পদ ব্যবস্থাপনায় মনোনিবেশ করা অনেক বেশি কার্যকর।
সম্প্রতি আমি বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান ব্যাংকের প্রাইরিটি ব্যাংকিং ও ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার পরিদর্শন করেছি। দেখেছি, অধিকাংশ ব্যাংকের প্যাকেজ প্রায় একই ধরনের—বিমানবন্দরে মিট-অ্যান্ড-গ্রিট সেবা, ফ্রি লাউঞ্জ ব্যবহার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কিছু সার্ভিস চার্জ মওকুফ ইত্যাদি। আকর্ষণীয় সুবিধা হলেও এগুলো বিশেষভাবে অনন্য নয়। ব্যাংকগুলোর সেবা প্রায় অভিন্ন। তবে প্রকৃত ফাঁক যেখানে আছে, তা হলো ব্যাংকারদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ঘাটতি। আসল সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দিতে ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রায়শই পর্যাপ্ত দক্ষ নন।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কেবল সুবিধাজনক সার্ভিসের আশেপাশে ঘুরবে না। এটি গ্রাহককে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বিনিয়োগ কৌশল এবং সম্পদ সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকার পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ পেশাদার, যারা শুধু আর্থিক পণ্যই জানে না, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকেও খেয়াল রাখে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে প্রাইরিটি বা ওয়েলথ ব্যাংকিংয়ে কাজ করা অনেক রিলেশনশিপ ম্যানেজার নতুন এবং সীমিত ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার।
ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে এই কর্মীদের দক্ষ পরামর্শদাতা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। উন্নত বাজারে, অভিজ্ঞ সিনিয়র ব্যাংকাররাই এই দায়িত্বে থাকেন। তারা গ্রাহকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিশ্বাসযোগ্যতা, বিচারবুদ্ধি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে আসে। নতুনদেরও ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টে আসা সম্ভব, কিন্তু তাদের আগে ব্যাংকিং নিয়মকানুন, আইন, নীতি মেনে চলা এবং আর্থিক পরিকল্পনার মৌলিক বিষয় শিখতে হবে। গ্রাহকের ব্যক্তির দক্ষতা, অভিজ্ঞতা পরিচালনার আগে এই জ্ঞান আবশ্যক।
তাদের কাজ শুধু কল উত্তর দেওয়া বা ট্যাক্স সার্টিফিকেট দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এআই এবং প্রযুক্তি অনেক মৌলিক প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব নিচ্ছে। রিলেশনশিপ ম্যানেজারদের এখন সেই দিকগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে যা স্বয়ংক্রিয় করা যায় না—গ্রাহকের চাহিদা বোঝা, বিশ্বাস তৈরি করা এবং ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সমাধান দেওয়া। মানবিক স্পর্শ এবং পেশাদার দক্ষতা মিলিত হলে অসাধারণ ওয়েলথ ম্যানেজারের স্বতন্ত্রতা ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এখনই ভাবা দরকার—শাখা বাড়িয়ে সাধারণ রিটেল সেবা দেওয়ায় নয়, বরং সম্পদ ব্যবস্থাপনার শক্তিশালী সক্ষমতা তৈরি করেই ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণ করতে হবে। প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ, পরামর্শ দক্ষতা উন্নয়ন এবং পেশাদারিত্বের সংস্কৃতি গড়ে তুলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে সফল হতে পারে এবং দেশের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: পারভেজ মোরশেদ, তিনি ছিলেন সিটিব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ভেঞ্চার্সে ব্যবসা প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। যোগাযোগ: parvez.murshed@gmail.com