উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও চলতি অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংকের আমানত বেড়েছে। তবে সাধারণ চলতি আমানতের চেয়ে মেয়াদি বা স্থায়ী (এফডিআর) আমানত বেশি হারে বাড়ছে। মূলত এই ধরনের আমানতের সুদ হার বেশি থাকায় মানুষ বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ব্যক্তিদের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এফডিআরে বড় অঙ্কের টাকা রাখছে। এর আগে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিদায়ী অর্থবছরের বেশির ভাগ সময় আমানতের বৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস শেষে ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৮০ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এটি ছিল ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮১ কোটি টাকা বা ৮.৪২ শতাংশ। ব্যাংকে আমানত দুই ধরনের হয়।
প্রথমটি, হলো চলতি আমানত। এটি এমন ধরনের আমানত, যা আমানতকারী যেকোনো সময়ে চেক, কার্ড বা অন্যান্য মাধ্যমে উত্তোলন বা জমা দিতে পারেন। চলতি আমানত সাধারণত চাহিদা অনুযায়ী হয়, তাই গ্রাহক দ্রুত এবং ঘন ঘন লেনদেন করতে পারেন।
দ্বিতীয়টি, হলো ফিক্সড ডিপোজিট বা মেয়াদি আমানত। এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাংকে জমা রাখা হয়। মেয়াদি আমানতের ওপর নিয়মিত সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায়। এটি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে পরিচিত। মেয়াদ সাধারণত তিন মাস থেকে শুরু করে তিন বছর বা তারও বেশি হতে পারে। মেয়াদি আমানতের মেয়াদ শেষে মূল টাকার সঙ্গে অর্জিত সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায়।
এছাড়া ব্যাংকগুলো মাসিক নির্দিষ্ট টাকা জমা রাখার সুবিধাও দেয়। এটি সাধারণত ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) নামে পরিচিত। ব্যাংকভেদে ডিপিএসের নাম ভিন্ন হতে পারে। ডিপিএসের ক্ষেত্রে ব্যাংক মাসিক, ত্রৈমাসিক, ছয় মাসিক বা বার্ষিক সুদ বা মুনাফা প্রদান করে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকের মোট আমানতের বেশি ভাগই মেয়াদি আমানত। চলতি বছরের জুলাই শেষে মেয়াদি আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা বা ৯.২ শতাংশ। একই সময়ে চলতি আমানতের বৃদ্ধি হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা বা ২.২৫ শতাংশ।
এর আগে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। সেই সময় ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার (রেপো রেট) বৃদ্ধি করা হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রমাগতভাবে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান গভর্নর তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছেন। এর প্রভাব হিসেবে ব্যাংকঋণের সুদহারও অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
জানা গেছে, বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছু দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৮৭৪ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকের কাছ থেকে এখনও উদ্ধার করা যায়নি। এই আমানতের বিপরীতে সরকার সুদ পাচ্ছে। এ ধরনের আরও কিছু দুর্বল ব্যাংকে সরকারি আমানত আটকে রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও ২০২৪ সালে রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছে। এর পেছনে উচ্চ সুদের সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড ক্রয় এবং ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে বেশি সুদ আদায় অন্যতম কারণ। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতা খুব বেশি বাড়ছে না; বরং কমছে। তারপরও ব্যাংকে আমানত, বিশেষ করে মেয়াদি আমানত বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকার পরিবর্তন এবং কিছু ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রেখেছিল। ফলে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমে গিয়েছিল। ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকার পরিমাণও বাড়ছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। তাই যারা অতিরিক্ত টাকা তুলেছিলেন, তারা এখন তা আবার ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন। সুদের হার বাড়ার কারণে নতুন আমানতও আসছে। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি নয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। বেকারত্বও বাড়ছে। তাই সঞ্চয় করার সক্ষমতা কমেছে। ফলে ব্যাংকের আমানত প্রত্যাশা অনুযায়ী বেড়াচ্ছে না। তবে যেটুকু বেড়েছে, তার মধ্যে মেয়াদি আমানতের অংশই বেশি।”
ড. জাহিদ আরো বলেন, “এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো এই আমানত কতটা নিরাপদ। যদি এগুলো পদ্মা ব্যাংকের মতো দুর্বল ব্যাংকে রাখা থাকে, তাহলে কতটা ফেরত পাওয়া যাবে, তা সন্দেহজনক। অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব খাটিয়ে সরকারি আমানত দুর্বল ব্যাংকে রাখা হয়েছিল। অর্থনীতির শ্বেতপত্রে আমরা ১০টি দুর্বল ব্যাংকের কথা উল্লেখ করেছি। এসব ব্যাংকে রাখা আমানত উদ্ধার করা যাবে কি না, সেটি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কিছু দুর্বল ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়েছে, কিন্তু সেই অর্থের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। তার নেতৃত্বে অন্তত ১৫টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা এবং বেনামি ঋণ বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও সব দুর্বল ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হয়নি, তবে অবনতি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়ায় সেগুলোতে আমানতও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে অনেক ব্যাংক মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ১২.২৫ শতাংশ সুদহার দিচ্ছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে আমানত কমলেও সবল ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে। আমানত বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে সিটি, ব্র্যাক, পূবালী, ইস্টার্ন, যমুনা, ট্রাস্ট, প্রাইম, এনসিসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা, শাহজালাল, উত্তরা, যমুনা, মিডল্যান্ড এবং সিটিজেন ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, “ব্যাংকই একমাত্র মাধ্যম যেখানে আমানত রাখা, ঋণ নেওয়া এবং আমদানি-রপ্তানি সহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। তাই মানুষ খুব বেশি দিন ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখতে পারবে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে, সেসব ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের চাপ বেড়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সবল ব্যাংকে রাখছে।
ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধির বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “সরকার পরিবর্তনের পর কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে গিয়েছিল। ফলে তারা ওই ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। এর প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতেই পড়েছিল। তবে বর্তমানে ব্যাংকের প্রতি আস্থা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে আমানতের পরিমাণও বেড়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।”
এর আগে নগদ টাকার সংকট ও নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ২০২৩ সালের জুন থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়তে শুরু করে। ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ এখনও পায়নি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখনও মূল্যস্ফীতি খুব বেশি কমছে না।
গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৮.৩৬ শতাংশ। এর আগে আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার আরও কমে দাঁড়ায় ৬.৩৫ শতাংশে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের বৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকলেও মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। ব্যাংকারদের মতে, মেয়াদি আমানতের সুদ বৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সুদ বাবদ আয় বাড়ানোর দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, “দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে মেয়াদি আমানতের জন্য ১২ শতাংশ সুদ চাচ্ছে। দুর্বল ও ছোট ব্যাংকগুলো এর চেয়েও বেশি সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করছে। আমরা যদি ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ১৪-১৫ শতাংশ সুদের নিচে ঋণ দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবে না। বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো দর-কষাকষি করে ঋণের সুদহার কমাতে পারছেন, কিন্তু এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো ১৫-১৬ শতাংশের নিচে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, “আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের পরিমাণও বেশ বড়। তাই তারা সুদ নিয়ে দর-কষাকষি করতে সক্ষম। তবে উচ্চ সুদের এই বাজারে সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে নতুন এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে তারা মেয়াদি আমানতে বেশি রেট দিচ্ছে। তবে যেসব ব্যাংক অত্যধিক উচ্চ রেট দিচ্ছে, সেগুলো হয়তো সংকটপূর্ণ অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ এসব ব্যাংকে তারল্যসংকট থাকতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাই যদি কোনো ব্যাংক এফডিআর বা অন্য কোনো সঞ্চয়ে বেশি মুনাফা ঘোষণা করে, তাহলে সচেতন গ্রাহক হিসেবে ঝুঁকিটা বিবেচনায় রাখা জরুরি। শুধু উচ্চ রেট দেখে সিদ্ধান্ত না নিয়ে ব্যাংকের শর্ত, তারল্য পরিস্থিতি, সুনাম ও স্থিতিস্থাপকতাও পরীক্ষা করতে হবে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা ঋণের সুদহার কমানোর দাবি জানিয়েছেন। গভর্নর জানিয়েছেন, আগামী মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার কিছুটা কমানো হতে পারে। এটি কার্যকর হলে ঋণের পাশাপাশি আমানতেও সুদহার কিছুটা কমে আসতে পারে।