দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ সীমিত ও দ্রুত কমছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প খাত ও গৃহস্থালিতে ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানীকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ওপর নির্ভরশীলতাও বেড়ে যাচ্ছে।
তবে অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এলএনজি আমদানিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা সহজ হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দেশের গ্যাস চাহিদা পূরণে বিকল্প হিসেবে এলপিজি কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশে এলপিজির দাম তুলনামূলক বেশি। এটি এলপিজি খাতের সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তবে সরকারি নীতি সহায়তা এবং আমদানি ও সরবরাহের জন্য যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তুললে ভোক্তাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি সরবরাহ করা সম্ভব।
গতকাল ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বণিক বার্তা আয়োজিত ‘বাংলাদেশে এলপিজি: অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম।
কনক্লেভে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন এলপিজি খাতের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা এবং সরকারি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে এলপিজির দাম বেশি হওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের কিছুটা দায় আছে। অন্যদিকে প্যানেল আলোচনায় ব্যবসায়ীরা এলপিজি খাতের অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও সরকারি নীতিসহায়তার ঘাটতি তুলে ধরেন। তারা বলেন, বন্দরে বড় এলপিজি জাহাজ ভিড়তে না পারায় পণ্য খালাসে দীর্ঘ সময় নষ্ট হয়। পাইপলাইন না থাকায় সরবরাহ ব্যবস্থাপনা জটিল হচ্ছে। এসব কারণে এলপিজির দাম বাড়ছে। অনেক ব্যবসায়ী লোকসান সামলে ব্যবসা চালাচ্ছেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে এলপিজি ব্যবসা করতে হলে একাধিক সরকারি সংস্থার কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হয় এবং ফি অনেক বেশি। ফলে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, পাশাপাশি উচ্চ নিবন্ধন ফি ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কনক্লেভে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ জানান, এলপিজি খাতের ব্যবসার জন্য দরকারি লাইসেন্সের সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। লাইসেন্স ফিও কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাসও দেন। বণিক বার্তা সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় কনক্লেভে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বর্তমানে এলপিজির ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১২০০ টাকার বেশি। তিনি উল্লেখ করেন, দাম ১ হাজার টাকার নিচে আসা উচিত।
উপদেষ্টা বলেন, ‘গ্রাহকের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে যে ১২০০ টাকার এলপিজি ১৪০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। আমরা মোবাইল কোর্ট চালাব। সরবরাহকারীদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। দায়দায়িত্বহীন ব্যবসা চলতে পারে না। দাম ১ হাজার টাকার নিচে আনতে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহযোগিতা আমরা নিশ্চিত করব। বেসরকারি খাতের পুরো এফিশিয়েন্সি পেতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এলপিজির দাম কমানো প্রয়োজন। শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহার আরেকটি চ্যালেঞ্জ। দামের কারণে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিদ্যুৎ কারখানায় এলপিজি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এজন্য ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
প্রতিনিয়ত দেশে গ্যাসের মজুদ কমে আসছে এবং খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। তিনি বলেন, ‘অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য তুলনামূলক সহজ প্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণের কাছে জ্বালানি পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। ব্যর্থ হলে দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে।’
জনসাধারণের কাছে সুলভ মূল্যে জ্বালানি পৌঁছে দিতে ব্যর্থতার প্রসঙ্গ তুলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘আমরা ১৮ কোটি মানুষের কাছে জ্বালানি পৌঁছে দিতে পারিনি। জ্বালানি সরবরাহ যেকোনো মূল্যে বাড়াতে হবে এবং তা মানুষের দোরগোড়ায় সুলভ মূল্যে পৌঁছানো জরুরি।’
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘এলপিজির মূল্য নির্ধারণে দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে—একটি হলো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, অন্যটি সৌদি আরব থেকে আমদানীকৃত গ্যাসের চুক্তিমূল্য। এই দুই উপাদানের ওঠানামার কারণে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ জটিল হয়ে ওঠে। মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিনালে বড় ও মাঝারি জাহাজের জন্য নোঙর সুবিধা উন্নত করা গেলে পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে এলপিজি খাত আরও কার্যকর ও প্রতিযোগিতামূলক হবে।’
এর আগে কনক্লেভে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম। তিনি বলেন, ‘ছয়-সাত বছর আগেও এলপিজির সরবরাহ ছিল ৮০ হাজার টন, এখন তা বেড়ে ১৫ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। বাজার ও চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০৩০ সালে চাহিদা ২৫ লাখ টনে, ২০৪১ সালে ৫০ লাখ টনে, আর ২০৫০ সালে ১ কোটি টনে পৌঁছাবে। এলপিজির ৮০ শতাংশ ব্যবহার হয় বাসাবাড়িতে, শিল্প ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার হয় ১২ শতাংশ। খাতে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। বাজারে ৯৮ শতাংশ সরবরাহ করে বেসরকারি খাত, সরকারি খাতের অংশ মাত্র ২ শতাংশ। বাজারে এলপিজির সিলিন্ডার রয়েছে ৪ কোটি এবং গড় মাসিক সরবরাহ ১ লাখ ৩০ হাজার টন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এলপিজি একমাত্র জ্বালানি যা কোনো ভর্তুকি ছাড়াই গড়ে উঠেছে এবং টিকে আছে। এটি প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজ বিকল্প হতে পারে। খাতের প্রসার এবং জনগণের কাছে সহজলভ্য করতে সহায়ক সরকারি নীতি প্রয়োজন। সরকারি খাতের অংশগ্রহণও জরুরি।’
কনক্লেভের প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, ‘বাংলাদেশে নিরাপদ জ্বালানির উদীয়মান খাত হলো এলপিজি। বর্তমানে দেশের চাহিদা ১৫ লাখ টন, যা আগামী কয়েক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এ খাত ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তবে খাতের চ্যালেঞ্জগুলোও সমাধান করতে হবে। বর্তমানে এলপিজির ৮০ শতাংশ ব্যবহার হয় গৃহস্থালিতে। কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও শিল্প খাতে এলপিজির চাহিদা রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই দাম কমানো প্রয়োজন, এজন্য কিছু জায়গায় নজর দিতে হবে।’
এলপিজি খাতে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। তিনি বলেন, ‘এলপিজি একটি বর্ধনশীল খাত। এর ব্যবহার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তাই নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতা জরুরি। ব্যবহারকারীদের জানতে হবে সিলিন্ডারের চিহ্নের মানে, কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, এবং ছোটখাটো দুর্ঘটনায় কী ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি প্রচার করা যেতে পারে পত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যম বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে।’
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘দেশে এলপিজি সরবরাহের অবকাঠামো নেই। উন্নত দেশে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়, আমরা এখনও সিলিন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহ করি। অবকাঠামো তৈরি হলে চাহিদা আরও বাড়বে। প্রথমে ছোট শহরগুলোকে পাইপলাইনের আওতায় আনা যেতে পারে।’ এলপিজি খাতের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, ‘এলপিজির লাইসেন্স নিতে গেলে ২০ ধরনের অনুমোদন পত্রের সঙ্গে কয়েক কোটি টাকা ফি দিতে হয়। বিপিসিকে বাজার ফি দিতে হয় লাখ লাখ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে এলপিজি সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে না, বরং একসময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
দেশের এলপিজি খাত “এনএসপিজি” পদ্ধতিতে চলছে—নো সাবসিডি, নো পেট্রোনাইজেশন, নো গভর্ন্যান্স। যার ইচ্ছে খুশি সেভাবে খাত পরিচালিত হচ্ছে। কোম্পানিগুলো এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি না করে গ্যাসের বাহন হিসেবে সরবরাহ করছে। সিলিন্ডার অনেক সময় ইস্পাতের দোকান বা ফিলিং স্টেশনে পুনঃভর্তি করা হয়। ফিলিং স্টেশনেই পুনঃভর্তি হলে এলপিজি অপারেটরের দরকার থাকে না। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও কোনো পদক্ষেপ হয়নি।’
এলপিজি গ্যাস ভোক্তাদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার গুরুত্বে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘ভোক্তাদের কাছে এলপিজি নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছাতে হলে রেগুলেটরি কমিশনকে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছলেই হবে না, তাদের সুরক্ষাও দিতে হবে। দেশের বাজারে এলপিজি দাম যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি, এটি কমানো জরুরি।’
গ্যাস আমদানিতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, ‘আমরা ছোট ও মাঝারি কার্গোতে গ্যাস আমদানি করি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে ডিসচার্জের অনুমতি নেই। কুতুবদিয়ায় ডিসচার্জ করতে বলা হয়, অথচ সেখানে সুবিধা নেই। আমাদের হাত বাঁধা থাকার কারণে অনেক কিছুই করতে পারি না। সরকার ইচ্ছেমতো নীতি তৈরি করে। যেকোনো নীতি অবশ্যই জনগণ ও অংশগ্রহণকারীর মতামত নিয়ে তৈরি করা উচিত।’
দেশের এলপিজি খাতে ব্যাংকগুলোর আরও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ইস্টার্ণ ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার। তিনি বলেন, ‘এলপিজি খাত দিন দিন বড় হচ্ছে। ব্যাংকিং দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই, এখানে ব্যাংক খাতের আরও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ব্যবসা যত বড় হবে, লাভ তত বেশি হবে। এটি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এলএনজি সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। এজন্য আমরা তিনটি বড় ঝুঁকি দেখি—মুদ্রার বিনিময় হার ওঠানামা, পণ্য পরিবহন খরচ এবং সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখা।’
ইউনাইটেড আইগ্যাস এলপিজি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হারুন ওরতাচ বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থে এলপিজি কোম্পানিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সহজ ও টেকসই জ্বালানি সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক গতি ধরে রাখতে এলপিজি কোম্পানি, ডিস্ট্রিবিউটর ও রিটেইলার গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানি না থাকলে কেউ খাবারও পাবে না। এলপিজি সরবরাহ ব্যবস্থা রক্ষা না করলে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।’
পেট্রোম্যাক্স এলপিজি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্কো অ্যান্টোনিও রড্রিগেজ ডি অলিভেইরা বলেন, ‘আমি ২০০৩ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে বাজার পরিদর্শন করতে এসে উৎসাহিত হয়েছিলাম। এখানে করার মতো অনেক কিছু ছিল। ডিলার, খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তা পর্যায়ে আরও পেশাদারত্ব আনার বড় সুযোগ আছে। বাংলাদেশে উচ্চমানের, নিরাপদ ও টেকসই এলপিজি শিল্প গড়ে তোলার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।’
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে সিরামিক কারখানায় এলপিজি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আকিজ বশির গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘সিরামিক উৎপাদনে গ্যাস হলো অক্সিজেন। কিন্তু আমরা খুবই কঠিন সময় পার করেছি। উৎপাদনের সময় গ্যাসের চাপ সামান্যও ওঠানামা হলে বিশাল ক্ষতি হয়। ২০২১-২২ সালে আকিজ সিরামিককে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে শুধু গ্যাস সরবরাহ সংকটের কারণে। এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হয়েছি। ওমেরার সহায়তায় কারখানাগুলোতে এলপিজি স্থাপন করেছি। তবে শিল্প উৎপাদনের জন্য এলপিজি কখনো প্রথম পছন্দ হতে পারে না। এর দাম অন্য জ্বালানির তুলনায় প্রায় ২০০ শতাংশ বেশি। এর পরও আমরা এলপিজি ব্যবহার করেছি শুধু উৎপাদন চালু রাখতে। পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে বাজারে সরবরাহ কমে এবং ভোক্তাদের আস্থা কমে। তাই ব্যবসা চালু রাখার জন্যই এলপিজি স্থাপন করা হয়েছে।’
উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে নওগাঁ থেকে আসা এলপিজি পরিবেশক স্যাটেলাইট এলপিজি প্লান্টের স্বত্বাধিকারী নৃপেন্দ্র কুমার মজুমদার বলেন, ‘এলপিজি ব্যবসায় কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মধ্যস্বত্ব ব্যয় কমানো সম্ভব। অপারেটররা সাধারণত মোংলা ও চট্টগ্রাম থেকে এলপিজি সরবরাহ করে। উত্তরবঙ্গে এলপিজি মোংলা থেকে আসে। একটি খালি বোতল মোংলায় ভর্তি করে আনতে ৬০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি জেলায় অপারেটররা বোতলজাত করার ব্যবস্থা করলে বোতলপ্রতি খরচ প্রায় ১০০ টাকা কমানো সম্ভব।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, ‘অপারেটররা অনেক সময় তৃণমূল পর্যায়ের খোঁজখবর রাখতে পারেন না। সিলিন্ডার কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে ও কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে, এ বিষয়ে নজর রাখা জরুরি। এলপিজি এখন হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বাসাবাড়ি ও গ্রামেও দেখা যায়। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি অপারেটরদের ভাবা উচিত। বিক্রির সময় নিরাপদ ব্যবহারবিষয়ক লিফলেট দিলে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমবে বলে আমার বিশ্বাস।’
বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল মাওলা বলেন, ‘বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা হলো পলিসি সমস্যা। এলপিজি গ্যাস প্লান্ট বসাতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স লাগে। ফাইল জেলা প্রশাসনের কাছে যায়, তারপর স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস, উপজেলা ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে যাচাই-বাছাই হয়। শুধু প্লান্ট স্থাপনের অনুমতি নিতে তিন-চার মাস লাগে। এরপর চূড়ান্ত লাইসেন্স পেতে আবার অনুমোদন প্রয়োজন। একজন ব্যবসায়ী এক-দুই বছর সময় ব্যয় করেন লাইসেন্সের জন্য। এভাবে চললে সে কীভাবে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করবে?’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ‘কৃষি, শিক্ষা ও জ্বালানি—এই তিন খাতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আগামী ১০ বছরে এই খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ যেন টেকসই হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি ও এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘এলপিজির নিবন্ধন ও নবায়ন প্রক্রিয়ায় নীতিগত সংস্কারের প্রয়োজন। এলপিজি লজিস্টিক খাত চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। অবকাঠামো না থাকলেও পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ডিস্ট্রিবিউশন করতে হয়।’
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংক এলপিজি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। মুদ্রা ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়নের সময় গ্রাহকের ওপর চাপ পড়ে। কারেন্সি কাভারেজের জন্য বিনিয়োগ করলে গ্রাহকদের ওপর চাপ কমবে। ভবিষ্যতের সরকার ও প্রজন্ম যদি এগুলো বাস্তবায়ন করে, দেশের অনেক উপকার হবে।’
‘বাংলাদেশে এলপিজি: অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে বিভিন্ন খাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এতে উপস্থিত ছিলেন এলপিজি, ব্যাংক, শিল্প, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা। কনক্লেভে উপস্থিত ছিলেন যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান, পেট্রোম্যাক্স এলপিজি লিমিটেডের পরিচালক ও কোম্পানি সচিব মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম, ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ মোল্লা, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, ইস্টার্ণ ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার, ইউনাইটেড আইগ্যাস এলপিজি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হারুন ওরতাচ ও চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার ওসমান চেলিক, মেঘনা ফ্রেশ এলপিজি লিমিটেডের চিফ মার্কেটিং অফিসার আবু সাঈদ রাজা, ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের সিইও তানজিম চৌধুরী।
এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সেনা কল্যাণ সংস্থা, পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট, রেস্টুরেন্ট ওনার্স, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন, এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য এবং বিভাগের প্রধানগণ।
শিল্প, ব্যাংক ও অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন প্রতিনিধি, যেমন পেট্রোম্যাক্স, আকিজ বশির গ্রুপ, সেফটেক এনার্জি সার্ভিসেস, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, এলপি গ্যাস লিমিটেড, ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেড, ক্যাসটল রক এনার্জি লিমিটেডসহ একাধিক কোম্পানির সিইও, পরিচালক ও চিফ অপারেটিং অফিসার কনক্লেভে অংশগ্রহণ করেন।