বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারের অন্যতম প্রধান উৎস সঞ্চয়পত্র বিক্রি কিন্তু চড়া সুদের চাপ সামলাতে সরকার ধীরে ধীরে সঞ্চয়পত্রের ঋণ নির্ভরতা কমাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমাতে ধাপে ধাপে কমানো হচ্ছে সুদের হার। এর ধারাবাহিকতায় আগামী জানুয়ারি থেকে আরও দেড় শতাংশ সুদ কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ডিসেম্বরেই বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন হার ঘোষণা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমিয়ে সরকার এখন বেশি জোর দিচ্ছে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যুর দিকে। কারণ এসব উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ তুলনামূলক কম। এতে সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল অবসরপ্রাপ্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, “সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়ছে, তার পরও সুদহার কমানো বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে। সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ড থেকে সস্তায় ঋণ পাচ্ছে, যা সরকারি অর্থ সাশ্রয় করবে। তবে সঞ্চয়পত্রনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য এটি চাপ তৈরি করবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুলাই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ৪৭ থেকে ৫৭ বেসিস পয়েন্ট কমানো হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ৭.৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে সুদ ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ করা হয়েছে। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের হার ১২ দশমিক ৩০ থেকে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশে নামানো হয়েছে। পরিবার সঞ্চয়পত্রের হার ১২ দশমিক ৫০ থেকে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশে এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের হার ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশে নামানো হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে এভাবে কয়েক দফায় কমেছে সুদহার, পাশাপাশি আরোপ করা হয়েছে কঠোর শর্ত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “আইএমএফের শর্ত পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ কমিয়েছে। এতে বয়স্ক, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ব্যাংক বেশি সুদ দেওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের আগ্রহও কমেছে।” ব্যাংকও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ সুদহার ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশে নামানো হয়েছে। জানুয়ারিতে এটি আরও কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসির নির্বাহী পরিচালক ড. এজাজুল ইসলাম বলেন, “মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে এখন পর্যাপ্ত টাকা আছে। তারা সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনছে, যার সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশের মতো। সরকার এখন সস্তা ঋণের এ উৎসে ঝুঁকছে। পুরনো সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় পরিশোধও বাড়ছে, ফলে নিট বিক্রি কমছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগের জুলাইয়ে ছিল ২ হাজার ১৮৭ কোটি। অর্থাৎ বিক্রি কমেছে ৮৯৪ কোটি টাকা বা ৪১ শতাংশ। আগের অর্থবছরগুলোতেও একই ধারা দেখা গেছে—২০২৪-২৫ সালে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ৬ হাজার ৬৩ কোটি, ২০২৩-২৪ সালে রেকর্ড ২১ হাজার ১২৪ কোটি এবং ২০২২-২৩ সালে ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “সরকার চায় মানুষ সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করুক। তাই বিকল্প উৎসে ঋণ নেওয়ার কৌশল নেওয়া হচ্ছে।”
গত ১৩ অক্টোবরের নিলাম অনুযায়ী, ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১৮২ দিনের ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিনের ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। ৮ অক্টোবর ২ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ১০ বছরের ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ, ১৫ বছরের ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ২০ বছরের ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছে। নতুন করে সুদ কমালে তারা বিকল্প বিনিয়োগের দিকে যাবে। তখন সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ড থেকে ধার নেবে, যার প্রভাব বিনিয়োগে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “এখন যেহেতু মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭ শতাংশে নেমেছে, তাই সুদহারও কমানো স্বাভাবিক। না হলে সরকার ঋণ পরিশোধে চাপের মুখে পড়বে।”