শুধু সাধারণ ব্যক্তির নয়, বড় অঙ্কের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতও আটকে আছে দেশের দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের কাছেই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩৭ হাজার কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) আটকে রয়েছে। এর বাইরে আরও অনেক দুর্বল ব্যাংকের কাছে বিপুল অঙ্কের এফডিআর রয়েছে, যা ফেরত দিতে পারছে না। ইতোমধ্যে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে মার্জার বা একীভূত করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে।
দুর্বল ২০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) আটকে আছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রাতিষ্ঠানিক এফডিআর। এর মধ্যে অতি দুর্বল ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাব, কমিশন বাণিজ্য ও উচ্চ সুদের লোভে এফডিআর রাখা হয়। এখন এটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব প্রতিষ্ঠান নিজে ডুবছে, অন্যকেও ডুবাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, দুর্নীতি না থামলে সমস্যা চলতেই থাকবে। কেউ কেউ বলছেন, এফডিআরের টাকা কোথায় রাখা হবে বা হবে না, তার জন্য একটি স্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, কোন প্রতিষ্ঠান কোথায় টাকা রাখবে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যবসায় নীতি। এখানে মূল সমস্যা দুর্নীতি। এটি বন্ধ না হলে সমস্যা সমাধান হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি দুর্বল ব্যাংকের কাছে আটকে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত এরকম:
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ১০,১৮৫ কোটি টাকা
- ইউনিয়ন ব্যাংক: ৮,৬৩১ কোটি টাকা
- এক্সিম ব্যাংক: ৮,১৫৭ কোটি টাকা
- সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক: ৫,৭৯১ কোটি টাকা
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ৪,৫৬৮ কোটি টাকা
এর পাশাপাশি পদ্মা ব্যাংকসহ আরও অনেক দুর্বল প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ফেরত দিতে পারছে না। ২০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ১৬,৩৬৭ কোটি টাকার প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ। আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাপক লুটপাটের শিকার ৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদের চিহ্নিত করা হয়েছে তিনটি সূচকের ভিত্তিতে: আমানত ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে সরকারের প্রায় ৯,০০০ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু তথ্য:
- এফএএস ফাইন্যান্স: ১৮১৪ কোটি টাকা ঋণের ৯৯.৯৩ শতাংশ খেলাপি, লোকসান ১৭১৯ কোটি
- ফারইস্ট ফাইন্যান্স: ৯৮% ঋণখেলাপি, লোকসান ১০১৭ কোটি
- বিআইএফসি: ৯৭.৩০% ঋণখেলাপি, লোকসান ১৪৮০ কোটি
- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: ৩৯৭৫ কোটি ঋণের ৯৬% খেলাপি, লোকসান ৪২১৯ কোটি
- পিপলস লিজিং: ৯৫% ঋণখেলাপি, লোকসান ৪৬২৮ কোটি
- আভিভা ফাইন্যান্স: ২৪৩০ কোটি ঋণের ৮৩% খেলাপি, লোকসান ৩৮০৩ কোটি
- প্রিমিয়ার লিজিং: ৯৮৪ কোটি ঋণের ৭৫% খেলাপি, লোকসান ৯৪১ কোটি
- জিএসপি ফাইন্যান্স: ৫১৫ কোটি ঋণের ৫৯% খেলাপি, লোকসান ৩৩৯ কোটি
- প্রাইম ফাইন্যান্স: ৫৩৪ কোটি ঋণের ৭৮% খেলাপি, লোকসান ৩৫১ কোটি
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, এ পরিস্থিতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শুধু কমিশন বাণিজ্য নয়, উচ্চ সুদের প্রলোভনের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরাও এফডিআর পেতে প্রভাব বিস্তার করতেন। বিশেষ করে ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এস আলমের প্রভাব বিস্তার প্রকাশ্যেই ছিল।