আমানতের হেফাজত ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত। আমানতদারিতা মানে হলো গচ্ছিত অর্থ বা অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে রক্ষা করা এবং পরে তা প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। ইসলামী ধারার ব্যাংকিংও গড়ে উঠেছে এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে। তবে দেশে বেশির ভাগ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গ্রাহকের আমানতের অর্থ ‘খেয়ানত’ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সংগঠিত অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডেরও অনুমোদন ছিল বলে জানানো হয়।
শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি বা শরিয়াহ বোর্ড ইসলামী ধারার ব্যাংকের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বোর্ডের মূল দায়িত্ব হলো ব্যাংককে ইসলামী নীতির মধ্যে পরিচালনা করা, শরিয়াহসম্মত ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং লঙ্ঘন থেকে রক্ষা করা, কিন্তু ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে বোর্ডের সদস্যরা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বনামধন্য অনেক ব্যক্তি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাধারণত সভার সম্মানী ৫ হাজার টাকা হলেও কেউ কেউ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের পরিবর্তন হলেও শরিয়াহ বোর্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য পরিবর্তন হলেও তা যথেষ্ট নয়। ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নৈতিক ব্যবস্থাপনার অভাব এখনও প্রবল চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ইসলামী ধারার পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসব ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। একই সময়, লুণ্ঠনের শিকার হলেও দেশের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিও একীভূত প্রক্রিয়ায় যায়নি। এই ছয়টি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মোট ১০ জন ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে এসব বোর্ডে প্রভাবশালী ছিলেন। নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার। তিনি এখনো সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত সবকটি ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। যদিও চেয়ারম্যান পদে না থাকলেও তিনি এখনো এ তিনটি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন। বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডে দায়িত্ব পালনকারী অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন:
- ঢাকার জামিয়াতুস সিদ্দিকীয়া দারুল উলুমের প্রধান মুফতি সাঈদ আহমেদ মুজাদ্দিদী
- চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ
- চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী
- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
- ড. মোহাম্মদ আবদুস সামাদ
- ঢাকার সাভারের জামিয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী
- বেসরকারি হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
- জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের জ্যেষ্ঠ ইমাম মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী
- ঢাকার বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু নোমান মো. রফিক রহমান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর বিপর্যয়ের জন্য শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। অন্যথায়, আগামীতেও একই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ঘটতে পারে। তবে শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা এ দাবির সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, বোর্ডের হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তারা শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ উপস্থাপন করা তথ্যের ভিত্তিতে ‘ফতোয়া’ প্রদানের অধিকারী।
সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার বলেছেন, শরিয়াহ বোর্ড দুদক বা কোনো তদন্ত সংস্থা নয়। এই কমিটির তেমন কোনো ক্ষমতাও নেই। কমিটির কাছে কোনো বিষয়ে ফতোয়া চাওয়া হলে কেবল সেই বিষয়েই ফতোয়া দেয়া হয়।
ড. গিয়াস বলেন, ব্যাংক কাকে বিনিয়োগ দিচ্ছে, কার কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে এসব বিষয়ে শরিয়াহ বোর্ডের কাছে কোনো তথ্য থাকে না। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যতটুকু তথ্য জানায় আমরা কেবল সেটুকুই জানি। কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করে ফতোয়া চাইলে আমাদের কিছু করার নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিন্সের ফাইন্যান্স বিভাগীয় অধ্যাপক এম. কবির হাসান বলছেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর দুর্দশার জন্য শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরও দায় নিতে হবে। তিনি বলেন, ইসলামে আমানতদারিতা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত কঠোর। আমানতের খেয়ানত কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
অধ্যাপক এম. কবির হাসান বলেন, শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা সমাজে আলেম হিসেবে পরিচিত। আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের ফেস ভ্যালু অনেক। তাই তাদের দায়িত্ব শুধু হালাল-হারাম নির্ণয় নয়। ব্যাংকে থাকা জনগণের আমানতের দায়িত্বও তাদের উপর আছে।
তিনি আরও বলেন, শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যরা জনগণের আমানত রক্ষা করতে পারেননি। এর পরিণতি হলো তাদের নৈতিক ও আইনগতভাবে জবাবদিহি করা দরকার। দুনিয়াতে খেয়ানতকারীদের বিচার না হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। কয়েকজন লোক দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেট তাদের শাসন রাখতে তরুণ ও আধুনিক ব্যাংকিং জানেন এমন শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের বোর্ডে ঢুকতে দেয় না। অধ্যাপক এম. কবির হাসান বললেন, ব্যাংকগুলোর দুর্দশার জন্য শুধু পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দণ্ডিত করা যথেষ্ট হবে না। শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরও দায়ভার মেনে শাস্তি হওয়া উচিত। অন্যথায় একই ধরনের অনিয়ম ভবিষ্যতেও ঘটবে।
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এখন পর্যন্ত ১৫টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছেন। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অডিট ফার্ম ‘আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং’ ও ‘কেপিএমজি’ দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। এই নিরীক্ষা গত মে মাসে শেষ হয়েছে।
একিউআর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকে জমা থাকা আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। আর বিতরণকৃত ঋণ বা বিনিয়োগের স্থিতি ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকাই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৭৬ দশমিক ৬৯ শতাংশই খেলাপি। একই সঙ্গে পাঁচ ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।
এ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৯৭ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, আর গ্লোবাল ইসলামীর ৯৫ দশমিক ১০ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ। একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের বাইরে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের বৃহত্তম এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪২ শতাংশ। সব মিলিয়ে শরিয়াহভিত্তিক এই ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপিযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হন ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময়ে দেশের বৃহত্তম ব্যাংকটিতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে।
এস আলম নিজে দেড় দশক ধরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময়ে ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন গিয়াস উদ্দীন তালুকদার। গ্রুপটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ছিলেন।
ড. গিয়াস উদ্দীন তালুকদার জানান, ইসলামী ব্যাংকিং অনুযায়ী মাদক, তামাকসহ শরিয়াহ নিষিদ্ধ ব্যবসায় ঋণ দেয়া যায় না। শরিয়াহ বোর্ডের দায়িত্ব হলো কোনো আয় নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলে তা যাচাই করে ফতোয়া দেয়া। ব্যাংকের বিনিয়োগ ও আমানত প্রডাক্টগুলো শরিয়াহভিত্তিক কিনা তা দেখার পাশাপাশি জাকাত তহবিলের অর্থ সঠিক খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা নজর রাখা। তিনি বলেন, “ব্যাংকের অনিয়ম ও অর্থ চুরি ঠেকানো মূলত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। তারা কী করেছে, সেটিই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা উচিত।”
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য হন। ২০২৩ সালে তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ পান। গণ-অভ্যুত্থানের পর তাকে শরিয়াহ বোর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়। কেবল ইসলামী ব্যাংক নয়, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকেরও শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। পরে সবক’টি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। দুর্দশায় পড়া ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৯৮ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে আছেন মুফতি সাঈদ আহমেদ মুজাদ্দিদী। তিনি ঢাকার জামিয়াতুস সিদ্দিকীয়া দারুল উলুমের (মাদ্রাসা-ই-ফুরফুরা) প্রধান। এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরও তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডে ছিলেন। একই সময়ে তিনি আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ও চেয়ারম্যানও ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
দুর্দশায় পড়া ব্যাংকগুলোর আরেক প্রভাবশালী সদস্য ড. মোহাম্মদ আবদুস সামাদ। তিনি ২০১৬ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য সচিব। ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডে যোগ দিয়েছেন ২০০৪ সালে। একই সঙ্গে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আভিভা ফাইন্যান্সের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন সময়ে তিনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ড. মোহাম্মদ আবদুস সামাদ ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের টিচার অব রিলিজিয়াস অ্যাটাশে পদেও রয়েছেন।
২০০৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী। একই সময়ে তিনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য সচিবও ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডে রয়েছেন। এছাড়া তিনি দেশের কয়েকটি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের শরিয়াহ উইংয়ের উপদেষ্টাও। ২০০৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী। তিনি ঢাকার সাভারের জামিয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও তিনি ব্যাংকটির শরিয়াহ বোর্ডে সদস্য হিসেবে থাকেন।
২০১৭ সাল থেকে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য পদে রয়েছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। তিনি একই সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান। বেসরকারি হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ব্যাপক জনপ্রিয়।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের জ্যেষ্ঠ ইমাম মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী ২০১৭ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য সচিব ছিলেন। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডেও ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানের পরও তিনি এসব ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। বর্তমানে তিনি এক্সিম ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য।
বর্তমানে ৯৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে ধুঁকতে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মো. মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিনি তিনটি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড থেকে বাদ পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে এক্সিম ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন অধ্যাপক ড. আবু নোমান মো. রফিক রহমান। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিনি একই পদে থাকছেন। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার, যিনি প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, “শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কমিটি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখে। সদস্য হিসেবে তারা সম্মানী পান। তাহলে দায়-দায়িত্বও থাকবে। ব্যাংকে সংগঠিত অনিয়ম-দুর্নীতির দায় তাদের ওপরও পড়ে। আমরা পুনর্গঠিত পর্ষদে শরিয়াহ কমিটির কয়েকজন সদস্য পরিবর্তন করেছি।”
গত এক দশক শরিয়াহ বোর্ডগুলোর সঙ্গে কাজ করা একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও কর্মকর্তারা জানান, শরিয়াহ বোর্ডের কিছু সদস্যের বিতর্কিত ভূমিকা পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে উৎসাহিত করেছে। আইন অনুযায়ী শরিয়াহ বোর্ডের সভায় সদস্যরা ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা সম্মানী পান। কিন্তু কিছু সদস্য সভায় উপস্থিতির জন্য ৫০ হাজার টাকা নিতেন। এই সম্মানির অর্থ ভুয়া ভাউচার ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংকের অন্য খাতে দেখানো হতো। শরিয়াহ বোর্ডের অনেক সদস্য নিয়োগ ও কেনাকাটায় তদবির করতেন। কোনো বিতর্কিত বিনিয়োগের বিষয়ে মতামত চাওয়া হলে শরিয়াহ বোর্ড এমনভাবে ফতোয়া দিত, যাতে বিনিয়োগ দ্রুত অনুমোদিত হয়।
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেছেন, “ইসলামী ব্যাংকের জাকাত তহবিলের ২০০ কোটি টাকা সরকারের মডেল মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছিল। জাকাতের টাকা কখনই মসজিদে দেওয়া যায় না। এই বিষয়ে শরিয়াহ বোর্ড কোনো আপত্তি করেনি। এছাড়া, আমানত সংকট শুরু হওয়ার পর ছয় বছরে দ্বিগুণ মুনাফার একটি আমানত প্রডাক্ট চালু করা হয়েছিল, যা স্পষ্টভাবে শরিয়াহবিরোধী। কিন্তু ওই সময়ের শরিয়াহ বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, শরিয়াহবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডে শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদের দায় থাকা উচিত। তিনি বলেন, “সবকিছুর দায়দায়িত্ব আইন বা নীতিমালায় উল্লেখ থাকে না। কিছু বিষয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশের সম্মানিত আলেমরা শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হন। এখন আইন দিয়ে তাদের শাস্তি নির্ধারণ করলে শরিয়াহ বোর্ডের মর্যাদা হ্রাস পাবে।”
আরিফ হোসেন খান আরও জানান, অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠন এবং দায়-দায়িত্ব সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ কমিটির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি শরিয়াহ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, আগামীতে শরিয়াহ কমিটির কার্যক্রমও তদারকি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে।