শিক্ষার খরচ মেটাতে বা সামান্য সঞ্চয় করার স্বপ্নে খুদে শিক্ষার্থীরা এখন ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত। আগে যেখানে মাটির ব্যাংকে কয়েন জমানো হতো, এখন তা ডিজিটাল ব্যালেন্সে দেখা যায়। দেশের ব্যাংকগুলো এখন শিশু-কিশোরদের আর্থিক হাতেখড়ির জায়গা হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ১৫ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে ২৩ লাখ ছেলে, আর ২২ লাখের বেশি মেয়ে শিক্ষার্থীর নামে হিসাব খোলা হয়েছে। গ্রামে এই উদ্যোগ আরও বিস্তৃত—২৩ লাখ ৯১ হাজার শিক্ষার্থীর হিসাব গ্রামে, শহরে ২১ লাখ ২৩ হাজার। সব খুদে সঞ্চয়কারীর ব্যাংকে জমা স্থিতি এখন ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শহরের শিক্ষার্থীদের অংশ ১ হাজার ৪৪৫ কোটি, গ্রামের অংশ ৬৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংখ্যা অনুযায়ী গ্রাম এগিয়ে থাকলেও সঞ্চয়ের পরিমাণে তারা পিছিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এই উদ্যোগ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি নতুন দরজা খুলেছে। করোনাকালে কিছুটা ভাটা পড়লেও এখন স্কুল ব্যাংকিং আবার জনপ্রিয় হচ্ছে। বড় কারণ ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল সেবা। অনেক স্কুলেই ব্যাংক প্রতিনিধি এসে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় হিসাব খুলে দেন। এতে স্কুল ফি, বৃত্তি বা উপবৃত্তির টাকা সহজে জমা বা উত্তোলন করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির কোনো জাদুকরি যন্ত্র নেই। প্রত্যেক স্কুলশিক্ষার্থীর ব্যাংক হিসাব নিশ্চিত করলে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ার ভিত্তি তৈরি হবে।”
২০১১ সালে মাত্র ১০০ টাকা জমা দিয়ে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের জন্য শুরু হয় স্কুল ব্যাংকিং। তখন কয়েকটি ব্যাংকে সীমিতভাবে হিসাব খোলা হতো। এখন দেশের ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টিতে স্কুল ব্যাংকিং রয়েছে। ৭১ শতাংশ হিসাব বেসরকারি ব্যাংকে। শুধু বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেই শিক্ষার্থীদের আমানত পৌঁছেছে ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভাগে এসেছে ৩৮০ কোটি টাকা। সবচেয়ে সক্রিয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ্-বাংলা, ইসলামী, অগ্রণী, সোনালী ও রূপালী ব্যাংক রয়েছে। বিশেষ করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ডিজিটাল স্কুল ব্যাংকিং সেবা সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর নাগাল পেয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “এই উদ্যোগ শুধু সঞ্চয় নয়, শিক্ষার্থীদের অর্থনীতির ধারায় যুক্ত করছে। এতে অভিভাবকের ওপর চাপ কমে, ব্যাংকও দীর্ঘমেয়াদি আমানত পায়। এই খুদে আমানত পরোক্ষভাবে জাতীয় বিনিয়োগের জ্বালানি।”
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান বলেন, “স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিশুরা এখন থেকেই টাকা ব্যবস্থাপনার কৌশল শিখছে। এতে সঞ্চয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিমা, বৃত্তি গ্রহণ বা স্কুল ফি পরিশোধের সুবিধা পাচ্ছে তারা।” মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র রবিন জানায়, “উৎসবে পাওয়া টাকা আর টিফিনের কিছু অংশ ব্যাংকে রাখি। পরীক্ষার সময় সেই টাকা তুলে খরচ করেছি। ভালো লাগছে, বাবার ওপর চাপ পড়েনি।”
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এই উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করতে মাঠে নেমেছে। চলতি বছরের মার্চে নির্দেশনা জারি করে বলা হয়, প্রতিটি ব্যাংকের শাখা অন্তত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল ব্যাংকিং চালু করবে। এতে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা পাবে। দেশের চার লাখের বেশি স্কুল হয়ে উঠবে আর্থিক শিক্ষার মাঠ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “এই উদ্যোগে সবাই লাভবান। শিক্ষার্থীরা সঞ্চয় করছে, অভিভাবকরা স্বস্তি পাচ্ছেন, ব্যাংকও আমানত বাড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে খুদে শিক্ষার্থীরাও এখন অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।”