বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত গত এক দশকে দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। মোবাইল ফাইন্যান্স সার্ভিস (MFS), ইন্টারনেট ব্যাংকিং, QR কোড পেমেন্ট, ডিজিটাল ওয়ালেট ও অনলাইন লেনদেনের বিস্তার অভূতপূর্ব। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। তবু আশ্চর্যের বিষয় ব্যাংক শাখায় মানুষের ভিড় কমছে না, বরং কিছু জায়গায় বেড়েছেও। গ্রাহকরা সরাসরি শাখায় গিয়ে চেক জমা, ঋণ আবেদন, রেমিট্যান্স, নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা, ফিক্সড ডিপোজিট ও বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই করছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করবো, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা, শাখাভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের অব্যাহত চাহিদা, গ্রাহকের আস্থা, নিরাপত্তা ও শিক্ষার প্রভাব এবং ভবিষ্যতের ব্যাংকিং সংস্কৃতির সম্ভাব্য রূপ।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা: বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেন শুরু হয় মূলতঃ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ২০১১ সালে ‘বিকাশ’ (bKash) চালুর পর থেকেই মানুষ নগদবিহীন অর্থপ্রদানে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। এরপর আসে রকেট, নগদ, উপায় সহ একের পর এক প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে প্রতি মাসে গড়ে ১ দশমিক ৩৫ ট্রিলিয়ন টাকা সমপরিমাণ লেনদেন হচ্ছে শুধুমাত্র মোবাইল ফাইন্যান্স সার্ভিসের মাধ্যমে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেনও বছরে প্রায় ৪৮% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। QR কোড ও POS মেশিন ব্যবহার করে মার্চেন্ট পেমেন্ট এখন প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজারেরও অধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চালু। তবে এর মধ্যেও “ডিজিটাল” কেবল শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকাগুলো এখনও মূলতঃ ব্যাংক শাখার উপর নির্ভরশীল।
ডিজিটাল ব্যাংকিং রূপান্তরের ধারা: প্রথমে দেখা যাক, সত্যিই ডিজিটাল লেনদেন কতটা বাড়ছে, অবস্থা কী, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন ডিজিটাল পেমেন্ট চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ- একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘Citytouch’ এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে ৮ দশমিক ৮২ লক্ষ হয়েছে এবং দৈনিক লেনদেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পর্যায়কে স্পর্শ করেছে।
আরো বলা হয়েছে, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্ল্যাটফর্ম ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং লেনদেন গত দুই বছরে যথাক্রমে প্রায় ৪৬ % ও ৫৯ % বেড়েছে। গবেষণা দেখাচ্ছে যে, ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ, মুঠোফোন-ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ইত্যাদি বাংলাদেশে ব্যতিক্রমী গতিতে ছড়াচ্ছে। এইসব তথ্য মিলে একটা বড় সার্কিট ইঙ্গিত দেয় যে, ব্যাংকিং-লেনদেনের গতিপ্রকৃতি পাল্টাচ্ছে, গ্রাহক-চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ডিজিটাল চ্যানেলের গুরুত্ব বাড়ছে।
যেখানে ডিজিটাল লেনদেন দ্রুত বাড়ছে, সেখানে স্বাভাবিক ধারণা হবে, শাখায় যাওয়া কমবে। কিন্তু বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। কয়েকটি পর্যবেক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো: একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন শাখার সংখ্যা আরও বাড়ছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের দিকে ব্যাংক শাখার সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৬৮৫টি। এছাড়া গবেষণা দেখায়, ব্যাংকিং গ্রাহকরা এখনও শাখায় যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন, বিশেষ করে জটিল লেনদেন, উপদেশমূলক কাজ, আত্মবিশ্বাস সঞ্চয়ের জন্য।
গবেষণা অনুসারে, “প্রত্যক্ষ শাখা এখনও গ্রাহক অধিগ্রহণ ও নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক” হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ক্ষতির শাখার সংখ্যা বাড়ছে যেমন: “অলস (loss-making) ব্যাংক শাখার সংখ্যা ১ হাজার ৬৮০ ছুঁইছই করেছে”। এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, হ্যা, ডিজিটাল ব্যাংকিং বাড়ছে, কিন্তু শাখার অবস্থান ও ব্যবহার কালক্রমে পুরোপুরি হ্রাস পাচ্ছে না এবং একরকম দুই ধরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধির পরও ব্যাংকে দীর্ঘ সারি: ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য মহানগরের ব্যাংক শাখায় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে লম্বা সারি দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে (২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিক) বলা হয়েছে “ দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯২ লক্ষ মানুষ ব্যাংক শাখায় সশরীরে উপস্থিত হন, যদিও তাদের প্রায় ৪৫% লেনদেন ডিজিটাল বিকল্পে করা সম্ভব।” অর্থাৎ প্রযুক্তি থাকলেও মানুষ এখনো ব্যাংকের মুখ দেখতে চায়।
এর কারণ হলো বিশ্বাস ও নিরাপত্তার মানসিক বাঁধা। বাংলাদেশের সাধারণ গ্রাহকের চোখে টাকা মানে এখনো “নগদে হাতে পাওয়া”। ডিজিটাল লেনদেনের পরেও ব্যাংক পাস বইতে ব্যালান্স না দেখলে অনেকের মন শান্ত হয় না। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা বিষয়। ২০২৫ সালে ‘Policy Research Institute’–এর এক জরিপে দেখা যায়, ৬২% গ্রাহক বিশ্বাস করেন ডিজিটাল লেনদেন “ঝুঁকিপূর্ণ”; ৫৭% মানুষ জানিয়েছেন “ভুল ট্রান্সফার হলে টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন” এবং ৪৮% গ্রাহক বলেন, “ব্যাংকের কাউন্টার থেকে কাজ করালে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।” এমন বিশ্বাসের কারণেই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বিকাশের পাশাপাশি “মানবিক উপস্থিতি”র চাহিদা কমছে না।
দ্বিতীয় কারণ হলো সেবা ও প্রযুক্তির অসম বন্টন। বাংলাদেশে এখনো প্রায় ৪০% শাখায় ইন্টারনেট সংযোগ অনিয়মিত এবং ২৫% ব্যাংকের ডিজিটাল অবকাঠামো পুরনো বা দুর্বল। ফলে অনেক সময় অনলাইন সেবা নিতে গিয়ে গ্রাহক বিপাকে পড়েন, অ্যাপ হ্যাং করে, OTP আসে না, বা সার্ভার ডাউন থাকে। এই অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে এবং তারা আবার “ম্যানুয়াল ব্যাংকিং”-এ ফিরে যান।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে বয়স ও শিক্ষা নির্ভর ডিজিটাল বিভাজন। বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবহারকারীদের বড় অংশ ১৮–৩৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। কিন্তু ৪০ বছরোর্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকে স্মার্টফোন বা অ্যাপ ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ নন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৪ সালের জরিপে দেখা যায়, “গ্রামীণ অঞ্চলের মাত্র ২৭% ব্যাংক গ্রাহক ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন নিয়মিত।” তাছাড়া অনেক গ্রাহক জানেনই না কীভাবে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা QR পেমেন্ট করতে হয়। ব্যাংকগুলোও এই বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ বা সচেতনতা প্রচারণা চালায়নি।
চতুর্থ কারণ হলো রেমিট্যান্স, ঋণ ও কাগজপত্র নির্ভরতা। বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের বড় অংশ নগদে তোলা হয়। রেমিট্যান্সের কাগজ, ফর্ম এবং আইডি যাচাই সবই সশরীরে করতে হয়। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ, ব্যবসায়িক লোন বা এলসি সংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রেও ব্যাংক কর্মকর্তার শারীরিক উপস্থিতি অপরিহার্য। ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এসব সেবা পুরোপুরি নিতে পারেনি।
পঞ্চম কারণ হচ্ছে আস্থার রাজনীতি, প্রতারণা ও সাইবার ঝুঁকি। ২০২৩-২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রতারণা ও ফিশিং ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৫ সালের প্রথম ৬ মাসে প্রায় ৬ হাজার টি অনলাইন প্রতারণা মামলা রেকর্ড হয়েছে। ফলে অনেক গ্রাহক এখনো “অ্যাপের মাধ্যমে টাকা পাঠানো”কে অনিশ্চিত মনে করেন। এই ভীতি কাটানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংকগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি শাখা না রাখলে আস্থা নষ্ট হয়। বাংলাদেশের প্রধান ব্যাংকগুলোর যেমন: সোনালী, ব্র্যাক, ডাচ-বাংলা, ইসলামী ব্যাংক, প্রিমিয়ার, ইত্যাদি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, তারা বলছেন, “ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু গ্রাহক-সম্পর্ক রক্ষায় শাখা অপরিহার্য।” একজন সিনিয়র ব্যাংকার বলেন, “যতই প্রযুক্তি আসুক, গ্রাহক চাইবেন কাউকে সামনে দেখতে, কথা বলতে, পরামর্শ নিতে। ব্যাংক হলো ‘বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান’ সেই বিশ্বাসের প্রতীক এখনো শাখা।” তাই ব্যাংকগুলো এখন এক ধরনের হাইব্রিড পদ্ধতি নিচ্ছে, তাহলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দ্রুত লেনদেন, তবে শাখায় মানবিক সেবা ও আস্থা রক্ষা।
ভবিষ্যতের পথ হবে “শাখা থাকবে, তবে রূপ বদলাবে”। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো এখন “স্মার্ট ব্রাঞ্চ” ধারণায় যাচ্ছে। শাখা থাকবে, কিন্তু বড় নয় ছোট, প্রযুক্তিনির্ভর, দ্রুত সেবা প্রদানের কেন্দ্র। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে ডাচ-বাংলা, ইউসিবি ও ইসলামী ব্যাংক এই ধরনের শাখা চালু করেছে। যেখানে নগদ কাউন্টার কম, ডিজিটাল কিওস্ক বেশি,
গ্রাহক নিজেরাই স্ক্যান করে কাজ সম্পন্ন করেন। এটাই ভবিষ্যতের ব্যাংকিং সংস্কৃতি হতে পারে, “human touch with digital speed “।
সফলতার জন্য নীতি নির্ধারণ ও শিক্ষা প্রয়োজন। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সফল বাস্তবায়নের জন্য দরকার তিনটি বিষয়- *শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: সাধারণ মানুষকে অ্যাপ ব্যবহার শেখানো। *নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা: সাইবার প্রতারণা প্রতিরোধে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বিত মনিটরিং এবং*ডিজিটাল অবকাঠামো বিনিয়োগ: সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে এখন একটি উত্তরণ-চক্র চলছে। ডিজিটাল লেনদেনের বিস্তার দ্রুত ঘটছে, নতুন প্ল্যাটফর্ম ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রাহক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু এ-কেন্দ্রিক পরিবর্তনের মধ্যেও শাখা-ব্যাংকিং সংক্রান্ত বহুবিধ কারণ আজও কাজ করছে; গ্রাহকের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা, গ্রামীণ ও দূরবর্তী এলাকায় অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ব্যাংকের কার্যকারিতা ও রূপান্তরের ধাপ, সামাজিক বিশ্বাস ও অভ্যাস সব মিলিয়ে।
শাখার ভিড় আজই না কমার কারণগুলো একক নয়, সহজ অপসারণযোগ্যেও নয়, চলমান রূপান্তর, সময় ও মনোভাব পরিবর্তনের বিষয়। তাই ব্যাংকগুলো ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শুধু “ডিজিটাল সেবা বাড়াও” বলেই থেমে যেতে হবে না, পাশাপাশি শাখার ভূমিকা পুনঃবিন্যাস করতে হবে। শাখাকে পার্থক্যমূলক ও যুক্তিসঙ্গত রূপ দিতে হবে, গ্রাহক-চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সেবা দিতে হবে।
এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, শাখায় ভিড় এখনও কমছে না। কারণ শাখা এখনও গ্রাহক-বিশ্বাস, সামাজিক যোগাযোগ, পার্সোনালাইজড সেবা, অবকাঠামোগত ব্যাকআপ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভবিষ্যতে পরিবর্তনের ধাপ দ্রুত আসছে এবং ব্যাংকিং খাতকে প্রস্তুত থাকতে হবে একটি হাইব্রিড, গ্রাহক-কেন্দ্রিক এবং প্রযুক্তি-নির্ভর মডেলে রূপান্তরিত হতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাত এক অদ্ভুত দ্বৈত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের উত্থান, অন্যদিকে শাখাভিত্তিক আস্থার নির্ভরতা। প্রযুক্তি যেমন নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে, তেমনি “মানবিক সংযোগ” এখনো গ্রাহকের চোখে অপরিবর্তনীয়। ভবিষ্যতে যে ব্যাংক এই দুই দিককে একত্রে ধরে রাখতে পারবে, সেই ব্যাংকই টিকে থাকবে সময়ের পরীক্ষায়।