অর্থনীতিবিদদের মতে, অনাদায়ী ঋণের বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অবৈধ তহবিল প্রবাহ এবং সম্প্রতি দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন হারানোর ফল।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নিয়ন্ত্রক শিথিলতার কারণে মন্দ ঋণ মার্চ মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ঢাকার একটি হোটেলে গতকাল (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় গবেষণাপত্র উপস্থাপনকালে বলেন, গত বছরের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১১.৬৬ শতাংশে পৌঁছে, যা প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি। এর ফলে প্রকৃত আয় কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাপক অর্থপাচার ও মূলধন বিদেশে পাচার তারল্য সংকটকে তীব্র করেছে এবং আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের বিশ্বাস কমিয়েছে। স্থায়ী মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক অস্থিতিশীলতা দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতিকেও উল্টে দিয়েছে। পিআরআই সুপারিশ করেছে, মুদ্রানীতি, ব্যাংক লাইসেন্স প্রদান, নিয়ন্ত্রণ, তদারকি এবং সরকারের ঋণায়নকে রাজনৈতিক বা নির্বাহী হস্তক্ষেপ থেকে পৃথক রাখা উচিত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-১৯৭২, ২০০৩ সালের সংশোধনের পরও আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি মূল্য ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং খাতভিত্তিক উন্নয়ন উৎসাহ দিতে যথোপযুক্ত নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স ডিভিশন গঠন এবং গত এক দশক ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমগত স্বায়ত্তশাসন সীমিত করেছে।
গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। খসরু বলেন, বিএনপি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করে। তবে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী না হলে স্বায়ত্তশাসনই যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ সবসময় থাকবে। প্রধান অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো বিএনপি শাসনের সময় বাস্তবায়িত হয়েছিল। তিনি ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও উল্লেখ করেন। বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক নিয়োগ দিইনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও বাতিল করেছিলাম, কিন্তু পরবর্তী সরকার পুনর্বহাল করেছে।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত এক দশকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্বল হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের সূচকগুলো তার প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখায়। তিনি বলেন, স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকা দেশে মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সহজ। ফাহমিদা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরের নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, শক্তিশালী আইন থাকলেও পদে নিযুক্ত কর্মকর্তার একাডেমিক উৎকর্ষতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও প্রতিশ্রুতি না থাকলে আইন কাগজে কলমেই থেকে যাবে।
লেদারগুডস ও ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ২০১৯ সাল থেকে আমরা ডলারের হার বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছিলাম। ২০২২ সালে একবারে ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যার প্রভাব সবাইকে সহ্য করতে হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতি ধারায় স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের জন্য আইন প্রণয়নের চেয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিটিএমএ’র সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, যারা দেশে থেকে গেছে, তাদের এখন উচ্চ ঋণখরচ বহন করতে হচ্ছে। এটি ন্যায়সঙ্গত নয় এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কঠিন করছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, আগে ক্রনি ক্যাপিটালিজম নিয়ে কথা বলতাম, এখন এটি অলিগার্কিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ব্যাংকিং খাত দখল হয়ে ক্ষতির দিকে ঠেলা হয়েছে। সর্ববৃহৎ সংস্কার হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালে। জাতীয় পরিচয়পত্র চালু হলে ভোট নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সবচেয়ে লজ্জাজনক নির্বাচন হয়েছে।
পিআরআই অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার বিষয়। মূল্যস্ফীতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তখনই, যখন প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি কম থাকে, অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকে। তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল তখনই সম্ভব, যখন এটি স্বাধীন। নব্বইয়ের দশক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অর্থনীতির মূল নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি যোগ করেন, রাজনৈতিক নেতাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
আলোচনায় বাংলাদেশের ব্যাংক সমিতির চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আখতার হোসেনও বক্তব্য রাখেন। পিআরআই ভাইস-চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ উদ্বোধনী বক্তব্য দেন এবং চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার সমাপনী বক্তব্য দেন।