একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা বেসরকারি খাতের পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের বড় অঙ্কের আমানতকারীরা আর তাদের অর্থ ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ভিন্ন নামে বা একই নামে রাখতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়ে কড়া নির্দেশ দিয়েছে।
যে কোনো আমানতকারী চাইলে তার জমা অর্থ তুলতে পারবেন—তবে ব্যাংক যদি অর্থ পরিশোধে সক্ষম থাকে। কিন্তু কোনো ব্যাংক যদি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সেই অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খসড়া রোডম্যাপে বলা হয়েছে, আমানতকারীদের অর্থ সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে। বড় অঙ্কের আমানত ফেরতের সময়সূচিও সেখানে নির্ধারণ করা আছে।
দুই লাখ টাকার মধ্যে আমানতকারীদের পূর্ণ সুরক্ষা
নতুন আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক দেউলিয়া, অবসায়িত বা একীভূত হলে আমানতকারীরা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত পুরো সুরক্ষা পাবেন।
অর্থাৎ যাদের আমানত দুই লাখ টাকা বা তার কম, তারা সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত পাবেন। এর বেশি অঙ্কের আমানত থাকলে তা সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে।
এই রোডম্যাপ কোন তারিখ থেকে কার্যকর হবে, তা প্রজ্ঞাপনে জানানো হবে। একীভূত হওয়ার তালিকায় রয়েছে—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক।
বড় অঙ্কের আমানত ভাঙছে ছোট হিসাবে
অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমানতকারীদের চাহিদামতো টাকা দিতে পারছে না। খেলাপি ও নিয়মিত ঋণ থেকে কিছু অর্থ আদায় করে তারা সীমিত পরিমাণ পরিশোধ করছে।
এ সুযোগে কিছু বড় আমানতকারী নতুন কৌশল নিয়েছেন—ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তাদের বড় অঙ্কের আমানত ভাগ করে একাধিক ব্যক্তির নামে ছোট ছোট হিসাব খোলা হচ্ছে। প্রতিটি হিসাবে দুই লাখ টাকার কম রাখা হচ্ছে, যাতে তারা সম্পূর্ণ অর্থ দ্রুত ফেরত পেতে পারেন।
ফলে ব্যাংকে মোট আমানত কমলেও বেড়ে যাচ্ছে হিসাবের সংখ্যা। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিশোধ পরিকল্পনা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা ও তদন্ত
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বড় অঙ্কের আমানত ছোট হিসাবে বিভক্ত করলে প্রকৃত হিসাব-নিকাশ বিকৃত হয়ে যাবে।
তারা ইতিমধ্যে পাঁচ ব্যাংকের তথ্য যাচাই করে রোডম্যাপ তৈরি করেছে—যেখানে দুই লাখ টাকার নিচের আমানতকারীর সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণ অনুযায়ী পরিশোধ সূচি নির্ধারিত।
কিন্তু বড় অঙ্কের আমানতকারীরা এখন নতুন নামে হিসাব খুলে অর্থ স্থানান্তর করছেন। এতে দুই লাখ টাকার মধ্যে থাকা হিসাবের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ডেকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে—কোনো বড় অঙ্কের আমানত ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করা যাবে না।
এ নির্দেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে কিছু ব্যাংকে তদন্তও শুরু হয়েছে।
নতুন ধারা যুক্তের চিন্তাভাবনা
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পাঁচ ব্যাংকের সব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের কাছে তথ্য রয়েছে—এই ব্যাংকগুলোতে নতুন কোনো আমানত আসছে না। বিদ্যমান আমানতকারীরাই অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না।
এ অবস্থায় যারা নতুন হিসাব খুলছেন, তাদের উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রে সৎ নয় বলে সন্দেহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তাই অসৎ উদ্দেশ্যে বা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা হলে তারা ঘোষিত রোডম্যাপের আওতায় আসবে না—এমন একটি নতুন ধারা যোগ করার চিন্তাভাবনা চলছে।
আমানত ফেরতের রোডম্যাপ
নতুন ব্যাংক চালুর পর একীভূত পাঁচ ব্যাংকের সব সম্পদ ও দায়দেনা সেখানে স্থানান্তর করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই ব্যাংকগুলোর দেনা তাদের দ্রুত নগদায়নযোগ্য সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। এজন্য পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার কোটি টাকা—অর্ধেক নগদে এবং বাকি অংশ সুকুক বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে।
অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানত সুরক্ষা তহবিল থেকে, আর অবশিষ্ট অর্থ করপোরেট আমানতকারীদের শেয়ার প্রদানের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।
নতুন ব্যাংক চালু হওয়ার পর প্রথমেই ফেরত দেওয়া হবে দুই লাখ টাকার মধ্যে থাকা আমানত। এর বেশি যাদের জমা আছে, তারাও প্রথম ধাপে দুই লাখ টাকা পাবেন। বাকি অর্থ ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ধাপে ধাপে দেওয়া হবে।
বড় অঙ্কের আমানত ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে কিস্তিতে ফেরত দেওয়া হবে। দুই বছর পর গ্রাহকরা বাকি অর্থ তুলতে পারবেন। মেয়াদি হিসাবগুলোর মেয়াদও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে এবং মেয়াদপূর্তিতে ব্যাংকের নির্ধারিত হারে মুনাফা পাবেন গ্রাহকরা।
বিশেষ বিবেচনায় ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ও গুরুতর অসুস্থ আমানতকারীরা রোডম্যাপের বাইরেও অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ পাবেন।

