বাংলাদেশে ব্যবসা করা বহুজাতিক ব্যাংকগুলো ২০২৩ সালে সর্বাধিক মুনাফা করেছে। অথচ পরের বছরই তাদের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে ব্যয় ছিল সবচেয়ে কম। এমন চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
তুলনায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো সিএসআরে শীর্ষে ছিল। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, দুর্যোগ ত্রাণ, নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খাতে তহবিল দিয়েছে।
স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো দ্বিতীয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তালিকার একেবারে শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলো।
“প্রভাবের দিকে নজর দিচ্ছি, খরচের নয়”
বিদেশি ব্যাংকগুলোর দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান দেখে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার ঘাটতি ভাবা ঠিক নয়। তাদের বক্তব্য— “আমরা অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ নয়, প্রকৃত প্রভাবের দিকে গুরুত্ব দিই।”
তবে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বিদেশি ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সিএসআর ব্যয়ে উৎসাহিত করা। কারণ, তাদের বার্ষিক মুনাফা দেশীয় ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি।
সিএসআরের উদ্দেশ্য কী
সিএসআর মানে ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি অংশ এমন কাজে ব্যয় করা, যা দেশের বড় সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করে— যেমন দারিদ্র্য হ্রাস, পরিবেশ রক্ষা বা টেকসই উন্নয়ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে সিএসআর খাতে ব্যয় করতে উৎসাহিত করা হয়, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। এর কোনো ন্যূনতম সীমাও নেই। তবুও তাদের ব্যয়ের তথ্য নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হয়।
কারা কত খরচ করেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—
- ২০২৩ সালে বিদেশি ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মুনাফা ছিল ৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।
- পরের বছর তারা সিএসআরে ব্যয় করেছে মাত্র ২৫ কোটি টাকা, যা মুনাফার ০.৫৬ শতাংশ।
অন্যদিকে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো আর্থিক সংকট সত্ত্বেও তাদের ২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার মুনাফার প্রায় ৯ শতাংশ সিএসআরে ব্যয় করেছে।
স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো ব্যয় করেছে ৪.২ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো মাত্র ০.৫৯ শতাংশ।
২০২৪ সালে নয়টি ব্যাংক কোনো সিএসআর ব্যয়ই করেনি। তাদের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠান। একটি নতুন ব্যাংকের ব্যয়ের মতো মুনাফাই ছিল না।
অগ্রণী ব্যাংক সিএসআরে ব্যয় করেছে ০.০৮ শতাংশ, উরি ব্যাংক ০.১৩ শতাংশ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ০.১৬ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ০.১৮ শতাংশ এবং সিটি ব্যাংক এনএ ০.১৯ শতাংশ।
বিপরীতে, মার্কেন্টাইল ব্যাংক তাদের লাভের ২১ শতাংশ, যমুনা ব্যাংক ১৫.৩ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংক ১৫.২ শতাংশ ব্যয় করেছে।
আর্থিক পরিমাণে এক্সিম ব্যাংক সর্বাধিক ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। প্রিমিয়ার ব্যাংক ৪৭ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৪২ কোটি টাকা করে ব্যয় করেছে।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মিলে সিএসআরে ১৬ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে— যদিও এদের কিছু ব্যাংক তখন আমানত ফেরত দিতেও হিমশিম খাচ্ছিল।
“প্রথমে আমানতকারীর নিরাপত্তা”
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, আর্থিক সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর আগে আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত।
তিনি বলেন, “বিদেশি ব্যাংকগুলো প্রতি বছর বাংলাদেশে বিপুল মুনাফা করছে। তাই তাদের আরও বেশি সিএসআর ব্যয় করা উচিত।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিশ্বে প্রথম ভারত ২০১৪ সালে সিএসআর বাধ্যতামূলক করে, যেখানে সক্ষম কোম্পানিগুলোকে গড় নিট মুনাফার ২ শতাংশ ব্যয় করতে হয়। একই ধরনের নিয়ম রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, মরিশাস ও ডেনমার্কে। যুক্তরাজ্য ও স্পেনে সিএসআরকে করপোরেট গভর্নেন্সের অংশ হিসেবে দেখা হয়।
তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এই আন্তর্জাতিক উদাহরণ অনুসরণ করে বহুজাতিক ব্যাংকগুলোর কম সিএসআর ব্যয়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর ব্যাখ্যা
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ ২০২৩ সালে সর্বাধিক লাভজনক ব্যাংক ছিল, কিন্তু সামাজিক খাতে তাদের ব্যয় ছিল তুলনামূলক কম।
ওই বছর তাদের মুনাফা ছিল ২৩৩৫ কোটি টাকা, ব্যয় মাত্র ২০ কোটি টাকারও কম— মোট মুনাফার ০.৮৫ শতাংশ।
২০২৪ সালে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩০০ কোটি টাকায়। তারা জানিয়েছে, ২০২৫ সালে সিএসআরে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে এরইমধ্যে ৫.৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে তারা।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বলছে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তারা কৃষি খাতে ৪৭ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক বিভাগে রিপোর্ট করা হয়েছে।
এইচএসবিসি ব্যাংকও প্রায় একই যুক্তি দিয়েছে। ২০২৩ সালে তাদের মুনাফা ছিল ৯৯৯ কোটি টাকা কিন্তু সিএসআরে ব্যয় মাত্র ২.৮৬ কোটি (০.২৯ শতাংশ)। ২০২৫ সালে ১.৮৯ কোটি ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে তারা।
এইচএসবিসি জানায়, তারা বৈশ্বিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও প্রকল্প চালায়— যেমন এইচএসবিসি ওয়াটার প্রোগ্রাম (২০১২–২০১৯), ইংলিশ অ্যান্ড ডিজিটাল ফর গার্লস এডুকেশন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি। এসবের মোট ব্যয় ছিল কয়েক কোটি টাকা, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএসআর প্রতিবেদনে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
সিটি ব্যাংক বাংলাদেশ জানিয়েছে, তারা সিটি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে দেশে সিএসআরে কাজ করছে।
১৯৯৯ সাল থেকে ফাউন্ডেশনটি বাংলাদেশে এনজিওগুলোকে ৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে।
২০২৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পে ১০.৭ কোটি টাকা, ২০২৪ সালে গৃহহীনদের জন্য ৫.৭৫ কোটি এবং ২০২৪ সালের আগস্টে বন্যা ত্রাণে ১.১৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে তারা।
কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন জানিয়েছে, তারা ২০২৩ সালে সিএসআর বাজেট দ্বিগুণ করেছে, ২০২৪ সালে ৪০ শতাংশ এবং ২০২৫ সালে আরও ১০৩ শতাংশ বাড়িয়েছে।
কমছে মোট সিএসআর ব্যয়
২০২৪ সালে ব্যাংক খাতের মোট সিএসআর ব্যয় আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। আগের বছরের তুলনায় ব্যয় কমেছে ৩৩ শতাংশ, মোটে ৬১৫ কোটি টাকা।
২০২২ সালে এই খাতের ব্যয় ছিল ১১৪২ কোটি টাকা— যা ছিল রেকর্ড।
মোট ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক গেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শীতবস্ত্র বিতরণ ও বন্যা ত্রাণে।
আগের সরকারের সময় অনেক ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলেও বড় অঙ্কের অনুদান দিয়েছে, যা অনেক সময় “রাজনৈতিক চাপে” দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা।
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক চৌধুরী বলেন, “এমন প্রভাবমুক্ত হলেও ব্যাংকগুলো কীভাবে সিএসআর প্রকল্প বেছে নেয়, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ।”
তার মতে, সিএসআরে প্রকল্প বাছাইয়ের সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি।
“অনেক ব্যাংক তাদের বোর্ড সদস্যদের এলাকার প্রকল্পে অর্থ দেয়, অথচ সিএসআরের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তৈরি করা,” বলেন তিনি।

