বিশ্বের কোথাও সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক গঠনের নজির নেই। তবে সেই উদ্যোগই নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রস্তাবিত ব্যাংকের সম্ভাব্য নামও ঠিক করা হয়েছে—‘সরকারি কর্মচারী ব্যাংক’।
জাতীয় বেতন কমিশন সরকারি চাকরিজীবীদের ‘দেশের বেতনভোগী একটি টেকসই শ্রেণি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের জন্য আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আলোচনা শুরু করেছে। সরকার ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ও সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে সভাপতি করে নতুন জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করে। কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠনের প্রস্তাবও তাদের আলোচনায় রয়েছে।
জাকির আহমেদ খান বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠনের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ সুপারিশ থাকতে পারে, আবার না–ও থাকতে পারে। তবে এই চিন্তা নতুন নয়—ফরাসউদ্দিন কমিশনও একসময় এমন প্রস্তাব দিয়েছিল।’
সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় বেতন কমিশন ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিল। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ের সরকারি জমি থেকে ২০–২৫ কাঠা বিক্রি করে ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’ নামের একটি ব্যাংক গঠনের কথা বলা হয়েছিল। সেই ব্যাংকের প্রস্তাবিত পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০০ কোটি টাকা। তবে প্রস্তাবটি পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।
নতুন বেতন কমিশনের দায়িত্ব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা ও সুবিধা পর্যালোচনা করে সুপারিশ করা। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা কার্যপরিধিতে নেই, তবু বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বেতন কমিশনের কিছু সদস্যের মতে, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার–ভিডিপির জন্য আলাদা ব্যাংক রয়েছে। তাই প্রায় ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্যও একটি ব্যাংক গঠনে আপত্তি নেই। তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ বার্ষিক ব্যয় এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।
আরেকটি যুক্তি হলো—সরকারি কর্মচারীরা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে বেতন পান। বদলি হলে ব্যাংক হিসাব পরিবর্তনে দেরি হয়। আলাদা ব্যাংক থাকলে এ ঝামেলা থাকত না। সেই সঙ্গে শিক্ষা, বিয়ে বা গৃহনির্মাণে কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুবিধাও দেওয়া যাবে। তবে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা এই প্রস্তাবকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন। অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘চিন্তাটির কথা শুনে আমি অবাক হয়েছি। পৃথিবীর কোথাও এমন ব্যাংক নেই। দেশে এখনই ব্যাংক বেশি। নতুন ব্যাংক না করে বিদ্যমান ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নত করাই উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোনো আন্তর্জাতিক নজির নেই। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংক ৬১টি, যার মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় একাধিক ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একবার বলেছিলেন, ‘দরকার না থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় এত ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।’
বিশেষ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে অতীতে চারটি ব্যাংক লাইসেন্স পেয়েছে—আনসার–ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক (১৯৯৬), ট্রাস্ট ব্যাংক (১৯৯৯), সীমান্ত ব্যাংক (২০১৬) এবং কমিউনিটি ব্যাংক (২০১৯)। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদিত কিছু ব্যাংকে অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। এতে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ইসলামি ধারার পাঁচটি ব্যাংক একত্র করে নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

