স্বল্প পরিচিত এএফসি হেলথ লিমিটেডকে একের পর এক ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। হাসপাতাল খোলার পর ভারতের ফর্টিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথ সেবা চালুর জন্য প্রতিষ্ঠানটির পরিধি বাড়াতে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কখনো ঋণ পরিশোধ করেনি। পাঁচটি ব্যাংকের কাছে এর মোট পাওনা ৫০০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের জন্য মামলা করেছে।
ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো ৪৫ থেকে ৬০ কোটি টাকার সম্পত্তি বন্ধক নিয়েছে। তবে একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে। এ তথ্য পাওয়া গেছে অর্থঋণ আদালতের মামলার নথি, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে।
এএফসি হেলথের খুলনা শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১৪ সালে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। পরে ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ইউনিটের জন্য আরও ঋণ দেওয়া হয়। সুদসহ ইসলামী ব্যাংকের মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। অন্য ব্যাংকগুলোর পাওনা যথাক্রমে— মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১৩০ কোটি, জনতা ব্যাংক ১০৫ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংক ১০৩ কোটি এবং ব্র্যাক ব্যাংক ১২ কোটি টাকা। সব ঋণই বর্তমানে খেলাপি। ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মালিকরা বেশির ভাগ সময় ফোনে সংযোগ রাখেন না। ফোনে রিং হলেও তারা কল ধরেন না।
এএফসি হেলথ লিমিটেডের ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে ঋণ আদায় ব্যাহত হচ্ছে। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মামলায় ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৫ গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির ছয় পরিচালকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। পরিচালকরা হলেন– চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম সাইফুর রহমান, জুয়েল খান, মো. সাইদুর রহমান, মো. আফজাল, মো. সাইদুল আমীন, জিয়া উদ্দীন ও শামসুদ্দোহা তাপস।
প্রতিষ্ঠানটি মূলত ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ঋণ গ্রহণ করেছে। একই মালিকদের অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান—এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস—ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল ঋণ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ছিল মাত্র ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রথম বছরে চার কোটি ৬৪ লাখ টাকার সেবা দিয়ে ৬০ লাখ টাকা নিট মুনাফা দেখানো হয়েছিল। পরবর্তী চার বছরে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করে মূলধন ১৪৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৯ সালে মোট ১৬৫ কোটি টাকার সেবা বিক্রি থেকে কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। মুনাফা দেখিয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এএফসি হেলথ আইপিও অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। তবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ফর্টিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউট অভিযোগ করে, চুক্তি অনুযায়ী তারা অর্থ পায়নি এবং এএফসি তাদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। পরে আইপিও প্রসপেক্টাসে জাল তথ্যের কারণে বিএসইসি এএফসির আইপিও অনুমোদন স্থগিত করে।
এএফসি হেলথ লিমিটেডের ঋণ ও আইপিও নিয়ে বিতর্ক আরও গভীর হচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনসহ যোগাযোগের জন্য দেওয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম সাইফুর রহমান এবং পরিচালক জুয়েল খানের মোবাইল নম্বরে কয়েক দিন ধরে ফোন ও এসএমএস করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। রিং দিলেও কল ধরেননি। কোম্পানির ফেসবুক পেজে দেওয়া নম্বরে ফোন করলে রাকিবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি এএফসি হেলথের কেউ নন। নাজিম নামের এক ব্যক্তি, যিনি আগে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর সূত্রে এই নম্বরটি পাওয়া গেছে। নাজিম জানান, এএফসি হেলথ অনেক আগেই কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, এএফসির আইপিও অনুমোদনের আবেদনের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর তৎকালীন সভাপতি ছায়েদুর রহমান। তিনি ছিলেন এএফসি হেলথের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার। সম্প্রতি ছায়েদুর রহমান বলেন, “এএফসি হেলথের কে কোথায় আছে আমার জানা নেই। প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে আমার কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়েছিল। পরে তা শেয়ারে স্থানান্তর করে আমাকে ফেরত দিয়েছে। সেই শেয়ার আমার নামে রয়েছে।” এ পরিস্থিতি নির্দেশ করছে যে, প্রতিষ্ঠানের ঋণ, আইপিও এবং পরিচালকদের কার্যক্রম নিয়ে এখনও ঝুলন্ত প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কার্যত বন্ধ থাকায় ঋণ ও বিনিয়োগের বিষয়গুলো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে বন্ধক হিসেবে দেখানো সম্পত্তির মূল্য যথাযথ নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ধকি সম্পত্তির মোট মূল্য ২০৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি করা যন্ত্রপাতির মূল্য ১৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ব্যাংকিং নিয়মে যন্ত্রপাতি জামানত দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া, এসব যন্ত্রপাতি আদৌ আছে কিনা ব্যাংক দেখাতে পারেনি। বন্ধকি সম্পত্তির দর মূল্যায়নের জন্য শাখা থেকে প্রতিবছর পরিদর্শনের বিধান থাকলেও ২০১৭ সালের পর এ ধরনের কোনো পরিদর্শন হয়নি। যেসব জমি বন্ধক দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর হালনাগাদ খাজনার রসিদও ব্যাংক দেখাতে পারেনি।
এএফসি হেলথের খুলনা ইউনিটের ঋণের বিপরীতে মুন্সীগঞ্জ সদরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাইদুর রহমানের ৭৯ শতাংশ জমি এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির ১৪ শতাংশ জমি বন্ধক হিসেবে দেওয়া আছে। মুন্সীগঞ্জের জমির সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ফোর্স সেল মূল্য ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। নারায়ণগঞ্জের জমির বাজার মূল্য এক কোটি ৪০ লাখ এবং ফোর্স সেল মূল্য এক কোটি ১২ লাখ টাকা। খুলনা ছাড়াও ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ইউনিটের জন্য সব মিলিয়ে বন্ধকির মূল্য ৪৫ থেকে ৬০ কোটি টাকা। তবে এসব সম্পত্তি আদৌ আছে কিনা ব্যাংকের কাছে নিশ্চিত তথ্য নেই।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের এমডি ওমর ফারুক খানের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি জানার পর পরে জানানো হবে। এছাড়া ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এএফসি হেলথের খেলাপি ঋণ আদায়ে পাঁচটি চেক ডিজঅনার মামলা এবং একটি অর্থঋণ মামলা চলমান। চেক ডিজঅনার মামলায় গত ১২ ও ২২ মে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ঋণ অনুমোদনের আগে ‘ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্ট’ করা ব্যাংকের দায়িত্ব। তা না করে প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া অপরাধ। এই ঋণ অনুমোদনে পরিচালনা পর্ষদের কোনো হস্তক্ষেপ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এএফসি হেলথের ঋণ দুর্নীতি: ব্যাংকগুলো বিপাকে, পরিচালকরা দেশত্যাগের পাঁয়তারা:
জনতা ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের এপ্রিলে এএফসি হেলথের কুমিল্লা ইউনিট প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য ৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি একটিও টাকা পরিশোধ করেনি। ২০২৩ সালে ৮৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার ঋণ আদায়ে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সুদসহ ব্যাংকের পাওনা এখন ১০৩ কোটি টাকা। মামলায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর আদালত এএফসি হেলথের পরিচালকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
আদালতের মতে, ঋণ নেওয়া হয়েছে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য, কিন্তু টাকা ব্যাংকে না দিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া তাদের বন্ধকি সম্পত্তির সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি নয়। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিপুল দায়দেনা রয়েছে। বর্তমানে পরিচালকেরা দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন, যা হলে বিপুল অঙ্কের ঋণ আদায় প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
ইস্টার্ন ব্যাংকও বিপাকে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এএফসি হেলথের নামে ৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ৩৩ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়া হয়। হাসপাতাল নির্মাণের নামে ঋণ নেওয়া হলেও সেখানে কোনো হাসপাতাল হয়নি। ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। মামলায় এএফসি হেলথের পরিচালকরা ছাড়াও এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডকেও বিবাদী করা হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সুদসহ ব্যাংকের পাওনা এখন ১০৩ কোটি টাকা।
ব্র্যাক ব্যাংক ২০১৬ সালে ১৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকার ঋণ দিয়েও পুরো অর্থ পায়নি। সুদসহ ব্যাংকের পাওনা এখন ১১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুই ধাপে লিজ অর্থায়ন সুবিধার মাধ্যমে ৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের জুনে প্রথমবারের মতো এই ঋণ শ্রেণিকৃত হয়, ২০২১ সালের মার্চে মন্দ মানে খেলাপি হয়। ২০২৩ সালে দুটি চেক বাউন্স মামলা দায়ের করা হয়, যার একটিতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। ২০২৪ সালের মার্চে ঢাকার অর্থঋণ আদালত ব্যাংকের পক্ষে রায় দেয়। এখন ঋণ আদায়ে অর্থ জারি মামলা চলছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২০১৯ সালের মার্চে প্রথমে ২০ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ দেয়। একই বছরের আগস্টে চলতি মূলধন হিসেবে আরও ৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়। পরে আরও কয়েক ধাপে ঋণ বৃদ্ধি পায়। সুদসহ এখন ব্যাংকের পাওনা ১৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ভালো উদ্যোগ হিসেবে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, এখন খেলাপি হওয়ায় আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
এ পরিস্থিতি নির্দেশ করছে যে, এএফসি হেলথের ঋণ ব্যবস্থাপনা ও হিসাবপত্রের স্বচ্ছতা নেই। ঋণ নেওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর কাছে অর্থ ফেরত আসেনি। পরিচালকেরা দেশত্যাগের পাঁয়তারা করছেন, যা আগামীতে ঋণ আদায় কঠিন করে তুলতে পারে।

