আগে মন্দ ঋণ টানা দুই বছর খারাপ না হলে তা অবলোপন করা যেত না অর্থাৎ খেলাপি ঋণ না হলে কোনো ঋণ বাতিল করা সম্ভব ছিল না। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের অকার্যকর ঋণ (এনপিএল) হার বর্তমানে ১৪ শতাংশ। তবে মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে ব্যাংকটি এই হার ৬ শতাংশে নামানোর পরিকল্পনা করছে। এর পিছনে মূল কারণ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্দ ঋণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অবিলম্বে বাদ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শ্রেণিভুক্ত সব ঋণের বিপরীতে তারা শতভাগ প্রভিশনিং বজায় রেখেছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঋণ অবলোপনের সার্কুলার খেলাপি ঋণ কমাতে সাহায্য করবে। এটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থান এবং ব্যালান্স শিটকে আরও শক্তিশালী করবে। আগের নিয়মে মন্দ ঋণ টানা দুই বছর খেলাপি না হলে তা অবলোপন করা যেত না। অর্থাৎ, খেলাপি না হলে কোনো ঋণ বাতিল করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন সার্কুলার জারি করেছে। এখন আর দুই বছরের শর্ত নেই। মন্দ ঋণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক তা অবলোপন করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)-এর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করার অন্তত ৩০ কার্যদিবস আগে ঋণগ্রহীতাকে নোটিশ দিয়ে এ বিষয়ে অবহিত করতে হবে।” তবে সব ব্যাংক এই সুবিধা নিতে পারবে না। কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “অনেক ব্যাংক এখনো লাভজনক নয়, তাই তারা এই সুবিধা নিতে পারবে না।”
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ স্বাগত জানালেন মন্দ ঋণ অবলোপনের নতুন নিয়ম:
পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, “এই পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণ সঙ্গে সঙ্গেই অবলোপন করতে পারবে। এতে ব্যালান্স শিট অনেক পরিষ্কার হবে। তবে ১০০ শতাংশ সঞ্চিতি বা প্রভিশন মুনাফা থেকেই নিতে হয়, তাই ব্যাংকের লাভ কিছুটা কমবে। আমরা শেয়ারহোল্ডারদের বেশি মুনাফা দেওয়ার চেয়ে ব্যালান্স শিটকে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী রাখতে চাই।” মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “এটি আমরা অনেকদিন ধরেই চাচ্ছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সতর্ক করে বলেন, “ব্যাংকগুলো যেন এটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার না করে। শুধু ঋণ অবলোপন করে ব্যালান্স শিট পরিষ্কার করলেই হবে না। অবলোপনের পর আদায় প্রক্রিয়াটিও যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ব্যাংকগুলোর রেটিং করে, তখন তাদের প্রভিশন ঘাটতি ও ঋণ পুনরুদ্ধারের হার যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।”
ঋণ আদায়ে প্রণোদনা এবং খেলাপির বর্তমান চিত্র:
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালার আলোকে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নগদ প্রণোদনা দেওয়া যাবে। কোনো ব্যাংকের যদি এ ধরনের নীতিমালা না থাকে, তবে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে তা তৈরি করতে হবে। চলতি বছরের জুন মাস শেষে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। এটি বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ ইতোমধ্যেই খেলাপি হয়ে গেছে।
ঋণ অবলোপন বাড়ালে লভ্যাংশে চাপ বাড়বে:
যত বেশি ঋণ অবলোপন করা হবে, ব্যাংকের মুনাফার ওপর তত বেশি চাপ পড়বে। ফলে অবলোপনের হার বাড়লে ব্যাংকের লাভে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। অনেক ব্যাংক অবলোপন না করেই লভ্যাংশ বিতরণ করে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করেন, এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য সঠিক নয়। তাদের মতে, ঋণ অবলোপন করলে মুনাফার ওপর চাপ তৈরি হয়, যা পরিচালনা পর্ষদকে আরও দায়িত্বশীল করে। তাই অবলোপনের পরও লভ্যাংশ দেওয়ার সঠিক চর্চা গড়ে তোলা প্রয়োজন। ১০০ শতাংশ অবলোপন করলে সরাসরি লভ্যাংশের ওপর চাপ পড়বে। সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এমন চাপ থাকা প্রয়োজন।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, “অবলোপন করলে মুনাফার ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়, যা ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য দরকার। কম মুনাফা পেলেও অবলোপন করা জরুরি—এটাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনুসৃত প্রক্রিয়া। অনেক ব্যাংক আছে যারা ঋণ খেলাপি না করেই প্রভিডেন্ট দেয়। তাই নিয়ম মেনে অবলোপন করতে হবে, এতে মুনাফার ওপর কিছুটা চাপ পড়ে।”
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “যদি নিয়ম মেনে প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা হয়, তাহলে টাকা আদায় সম্ভব হবে। ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখা হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। মুনাফায় প্রভাব না পড়লে পর্ষদ নড়াচড়া করবে না। কিন্তু মুনাফায় চাপ পড়লে পর্ষদ নিজেরাই জোর দেবে যেন অবলোপনকৃত ঋণের টাকা আদায় করা যায়।”
আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও ঝুঁকি:
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাংকগুলো আর দুই বছর ধরে টানা মন্দ ঋণ রাখতে চায় না। যত দ্রুত অবলোপন করা যায়, তত দ্রুত খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হয়। এতে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাও উন্নতি পায়।” তিনি আরও জানান, ব্যাংক খাতে এমন অনেক মন্দ ঋণ রয়েছে, যেগুলো আদায় সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা মনে করছে। তাই এসব ঋণ এখন অবলোপনের সুযোগ পাচ্ছে।
ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বলেন, “ভালো ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখে। তারপরও সেই ঋণ দুই বছর ধরে ব্যালান্স শিটে রাখতে হয়, যা ব্যাংকের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। অবলোপনের সুযোগ পেলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও কমানো সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, “যত দ্রুত অবলোপন করা যায়, তত দ্রুত ব্যালান্স শিটের উন্নতি ঘটে। রাইট-অফ করার পরও ব্যাংক সেই টাকা আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য অপব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, “যদি ব্যাংকগুলো এই ধারণায় ঋণ বিতরণ শুরু করে যে দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে বা সহজে অবলোপন করা যাবে, তাহলে এই ব্যবস্থার অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের আচরণ রোধে সঠিক তদারকি অত্যন্ত জরুরি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ঋণ অবলোপনের নিয়ম ব্যাংক খাতের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দ্রুত মন্দ ঋণ অবলোপনের সুযোগ ব্যাংকের ব্যালান্স শিটকে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করবে। ব্যাংকাররা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, আর অর্থনীতিবিদরা এই প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করছেন। তবে নতুন সুবিধার সঙ্গে কিছু চাপ ও দায়িত্বও আসে। ঋণ অবলোপনের ফলে ব্যাংকের মুনাফায় চাপ পড়বে, লভ্যাংশ বিতরণে সিদ্ধান্ত আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। একই সঙ্গে প্রণোদনা ও আদায়ের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে মেনে চলা জরুরি, যাতে অপব্যবহার রোধ করা যায়।
সংক্ষেপে, এই নতুন নিয়ম ব্যাংকের আর্থিক স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা বাড়াবে। তবে ফলপ্রসূতা নির্ভর করবে নিয়ম মেনে অবলোপন, আদায় এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার উপর। ব্যালান্স শিট শক্তিশালী হবে, কিন্তু সতর্কতা ও দায়িত্ব যেন সর্বদা বজায় থাকে—এটাই মূল চাবিকাঠি।

