রপ্তানিকারকদের তাৎক্ষণিক টাকার চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক নতুন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। এই প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় রপ্তানিকারকরা তাদের এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) অ্যাকাউন্টে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা নিতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে তারা টাকা ফেরত দিয়ে সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত পাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য হলো রপ্তানিকারকদের নগদ চাহিদা মেটানো এবং ব্যাংক খাতে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহে স্থিতিশীলতা আনা। শিগগিরই এই বিষয়ে একটি সরকারি সার্কুলার জারি করা হবে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “অনেক সময় রপ্তানিকারকদের ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা জমা থাকে, কিন্তু তারা তা নগদে রূপান্তর করতে চায় না। অন্যদিকে তাদের টাকার প্রয়োজন হয়। ব্যাংক থেকে ঋণও অনেক সময় সহজে পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকরা সহজে টাকা পেতে পারবে এবং ব্যাংকগুলোকে অর্থায়নে উৎসাহিত করতেই সোয়াপ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে আমদানি দায় পরিশোধ, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ বা ডলারের সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় অনেক রপ্তানিকারক ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে ডলার রাখেন। নতুন ব্যবস্থায় তারা ওই ডলারের বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাংলাদেশি টাকা নিতে পারবেন।
প্রক্রিয়াটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে কর্মকর্তা বলেন, “ধরুন একজন রপ্তানিকারক তার ইআরকিউ অ্যাকাউন্ট থেকে এক ডলার ব্যাংককে দেন। ব্যাংক সেই দিন বাজারদরে সমপরিমাণ টাকা তাকে এক মাসের জন্য দেবে। এক মাস পর ব্যাংক সেই এক ডলার ফেরত নেবে এবং রপ্তানিকারক ব্যাংককে টাকা ফেরত দেবে। এই সময়ে উভয় পক্ষের জন্য আলাদা সুদহার নির্ধারণ করা হবে—ব্যাংক টাকার ওপর সুদ পাবে, আর রপ্তানিকারক ডলারের ওপর সুদ পাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন সোয়াপ ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। তবে সুদের হার, সোয়াপের মেয়াদ এবং প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি। শীঘ্রই ব্যাংক এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করে সুদহার, মেয়াদ ও পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকদের অবহিত করবে। ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, সোয়াপ ব্যবস্থা চালু হলে রপ্তানিকারকদের তারল্য সংকট কিছুটা কমবে এবং ডলার বাজারের ওপর চাপও প্রশমিত হতে পারে।
একজন বিশ্লেষক বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ডলার বাজার অস্থির। ডলারের বিনিময় হার ধাপে ধাপে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে চলতে গিয়ে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমদানি ব্যয়ের চাপ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। আমদানি চাহিদা বাড়লে ডলারের দর আরও বেড়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ইআরকিউ অ্যাকাউন্টের ডলারের বিপরীতে টাকা সোয়াপ উদ্যোগ সময়োচিত।”
বাংলাদেশের নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “উদ্যোগটি রপ্তানিকারকদের তাৎক্ষণিক টাকার চাহিদা মেটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইআরকিউ (এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটা) অ্যাকাউন্ট হলো একটি বিশেষ বৈদেশিক মুদ্রা অ্যাকাউন্ট। রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আয় থেকে নির্দিষ্ট অংশ এই অ্যাকাউন্টে রাখতে পারেন। সংরক্ষণের হার নির্ভর করে রপ্তানি পণ্যের খাতের ওপর। উদাহরণস্বরূপ:
- আইসিটি খাতের রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত রাখতে পারেন।
- নিট পোশাক, কৃষি ও পাট খাতের জন্য সীমা ৩০ শতাংশ।
- ওভেন পোশাক খাতের জন্য সীমা ৭.৫ শতাংশ।
এই অ্যাকাউন্টে ডলার, পাউন্ড, ইউরো ও ইয়েনের মতো বৈদেশিক মুদ্রা রাখা যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ রপ্তানি ডলারে হয়, ফলে ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে ডলারের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে রপ্তানিকারকদের ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫০ কোটি ডলার জমা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য মুদ্রার সমপরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ডলার রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রি-শিপমেন্ট পুনঃঅর্থায়ন তহবিল বন্ধ হওয়ার পর থেকে রপ্তানিকারকদের জন্য তাৎক্ষণিক অর্থ জোগাড়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় চালু হওয়া ওই তহবিল বন্ধ হওয়ায় নগদ টাকার প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে, যা রপ্তানিকারকদের কার্যক্রমে চাপ সৃষ্টি করছে।
রপ্তানিকারকদের জন্য সোয়াপ উদ্যোগ: কার্যকারিতা নির্ভর করবে সুদহারের ওপর:
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, “এখন রপ্তানিকারককে তার ডলারের সম্পূর্ণ মালিকানা ছেড়ে দিয়ে টাকা নিতে হয়। নতুন সোয়াপ ব্যবস্থায় রপ্তানিকারক ডলারের সম্পূর্ণ স্বত্ত্ব ত্যাগ না করেই টাকা নিতে পারবেন। এটি রপ্তানিকারকদের জন্য অর্থ পাওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি করবে। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে সুদহার ও সহজ পদ্ধতির ওপর। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল। এই অবস্থায় সুদহার বেশি হলে রপ্তানিকারকরা অংশগ্রহণে আগ্রহী হবেন না।”
বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “সোয়াপ ব্যবস্থার সুদহার যৌক্তিক হতে হবে। ডলারের বিপরীতে যে সুদহার ধরা হবে, টাকার বিপরীতে তার তুলনায় ২ শতাংশের বেশি হওয়া ঠিক হবে না। এর মেয়াদ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রাখা উচিত। এছাড়া রপ্তানিকারকের মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ থাকা দরকার।”
বাংলাদেশের গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “বর্তমানে বাজারের প্রচলিত সুদহারের তুলনায় প্রস্তাবিত সোয়াপ সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকবে। কারণ ইআরকিউ অ্যাকাউন্টের তহবিল সাধারণত আর্থিকভাবে শক্তিশালী রপ্তানিকারকদের। এই ধরনের রপ্তানিকারকরা উচ্চ হারে ডলার সোয়াপে অংশ নিতে আগ্রহী হবেন না।”
বিজিএমইএ-এর একজন পরিচালক জানান, “ইআরকিউ ডলারের সোয়াপ ব্যবস্থা রপ্তানিকারকদের তাৎক্ষণিক নগদ সংকট মোকাবিলায় কার্যকর হতে পারে। তবে সুদহার ও প্রক্রিয়াটি সহজ রাখতে হবে, নাহলে অংশগ্রহণ কম হবে।” রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বলেন, “সোয়াপের মেয়াদ ও সুদহার নির্ধারণ জটিল হতে পারে। এতে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।

