নগদ অর্থের ব্যবহার এখনো প্রবল। প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন লেনদেন নগদে করছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ডিজিটাল বা ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ালে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বর্তমানে ব্যয়ের বড় অংশ চলে টাকা ছাপানো, পরিবহন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর। পুরোপুরি ক্যাশলেস সমাজে যাওয়া এখনো কঠিন। তবে ‘লেস ক্যাশ’ অর্থনীতি গড়ে তুললে এই ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি, নগদ ব্যবহার কমালে নোটের আয়ুষ্কাল বাড়বে, ছাপানোর খরচ কমবে এবং সাশ্রয় হওয়া অর্থ অন্য উন্নয়ন খাতে ব্যবহার করা যাবে। ব্যাংক ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে তিনটি দিকে জোর দিচ্ছে—নাগরিক সচেতনতা, ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি পেলে মানুষ নিরাপদে লেনদেন করতে পারবে, সরকার ব্যয় কমাতে পারবে এবং আরও বেশি মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে। তবে এর জন্য মানসিকতা পরিবর্তন এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা অপরিহার্য।
লেস ক্যাশ’ সমাজ গড়ার প্রয়োজনীয়তা:
বাংলাদেশে নগদ অর্থের ব্যবহার এখনও প্রচলিত। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নগদ ব্যবহার কমালে নোটের আয়ুষ্কাল বাড়বে, ছাপানোর খরচ কমবে এবং সাশ্রয় হওয়া অর্থ অন্য উন্নয়ন খাতে ব্যবহার করা যাবে। ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে ব্যাংক তিনটি দিকে জোর দিচ্ছে—নাগরিক সচেতনতা, ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগ। তবে মানসিকতা পরিবর্তনই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত ১০ আগস্ট বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর এক অনুষ্ঠানে বলেন, টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ এবং সারাদেশে পরিবহন ও বণ্টনে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। রাষ্ট্রের এ বিপুল খরচ কমাতে হলে নগদ ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে এবং ক্যাশলেস লেনদেন বাড়াতে হবে।
গভর্নর জানান, এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেন জনপ্রিয় করার জন্য নীতিগত সহায়তা এবং প্রযুক্তি অবকাঠামো তৈরি করছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কিউআর কোড ব্যবহার করতে হবে। এতে ব্যবসায়ী থেকে ভোক্তা—সবার লেনদেন হবে দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ। ক্যাশের ব্যবহার কমলে রাষ্ট্রীয় খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজিটাল লেনদেন বাড়লে মানুষ নিরাপদে লেনদেন করতে পারবে, সরকার ব্যয় কমাবে এবং আরও বেশি মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে। তবে এর জন্য মানসিকতা পরিবর্তন এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা অপরিহার্য।
ক্যাশলেস লেনদেনে অনাগ্রহী:
দেশে ডিজিটাল লেনদেন বা ক্যাশলেস পেমেন্ট বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বাংলা কিউআর’ চালু করেছে। দেশের সব ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে এর মাধ্যমে লেনদেনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবু, নগদ অর্থের ওপর নির্ভরতা এখনো বেশি। রাজধানীর মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট দোকানগুলোতে কিউআর কোড থাকলেও অনেক ব্যবসায়ী তা ব্যবহার করছেন না।
ব্যবসায়ী ও সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি ডিজিটাল লেনদেনে বাধা:
মতিঝিল এলাকার রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আমজাদ আলী বলেন, ‘ডিজিটাল লেনদেন করলে কর দেখানো সহজ হবে। তাই টার্নওভার কম দেখানোর জন্য অনেকেই নগদ লেনদেন বেশি পছন্দ করেন। এছাড়া গ্রাহকদের মধ্যেও আগ্রহ কম।’ এলাকার দোকানি রফিক মিয়া জানান, ‘আমার দোকানে অনেক গ্রাহক আসেন। তারা কিউআর কোড ব্যবহার করতে জানে না। নগদে লেনদেন করতে অভ্যস্ত, ডিজিটাল পেমেন্ট করতে চায় না।’
ঢাকার মগবাজার এলাকার বাসিন্দা রুমা খাতুন বলেন, ‘আমি ডিজিটাল পেমেন্ট করতে চাই, কিন্তু সবাই তা মানে না। অনেক জায়গায় নগদ ছাড়া লেনদেন করা যায় না।’ উবার চালক রাব্বি আহমেদ যোগ করেন, ‘আমি চাইলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারি, কিন্তু প্রতিটি দোকানে কিউআর কোড নেই। নগদই এখন নিরাপদ মনে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ডিজিটাল লেনদেন স্বচ্ছতা বাড়ায়, ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পাওয়া যায় এবং ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়। তবে নাগরিকদের মানসিকতা পরিবর্তন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া জরুরি।’
বেসরকারি ও সরকারি প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অনাগ্রহ মূলত কর জটিলতার আশঙ্কা, অভ্যস্ততার অভাব এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা পরিচালক হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘নিরাপদ ও সহজ ডিজিটাল লেনদেন প্রচারের পাশাপাশি সচেতনতা এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধিই মূল চাবিকাঠি।’
চলমান নোট, ডিজিটাল লেনদেন ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ:
দেশের সব নোট বাংলাদেশ টাকশাল (দ্য সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিং করপোরেশন, গাজীপুর ইউনিট) থেকে ছাপানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী নতুন নোট ছাপিয়ে বাজারে সরবরাহ করে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, কাগজের নোটের আয়ুষ্কাল মাত্র ছয় থেকে আট মাস। এই সময়ের মধ্যে অধিকাংশ নোট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। কয়েনের খরচ বেশি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী। পলিমার নোট চালুর চেষ্টা এখনো কার্যকর হয়নি।
ডিজিটাল লেনদেনে উদ্দীপনা: বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘বাংলা কিউআর’ চালু করে। এতে স্থানীয় ভাষায় সহজ পেমেন্ট সুবিধা দেওয়া যায়। সব ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের মধ্যে আগ্রহ এখনো কম। কর-জটিলতার আশঙ্কা ও নগদে স্বাচ্ছন্দ্য ডিজিটাল লেনদেন এড়িয়ে যাওয়ার মূল কারণ।
ডিজিটাল ব্যাংক আসছে: কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। নতুন নীতিতে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধনের সীমা ৩০০ কোটি টাকা, যা আগে ছিল ১২৫ কোটি টাকা। ডিজিটাল ব্যাংক কোনো শাখা বা ওটিসি সেবা দেবে না। সব লেনদেন হবে অ্যাপ ও ডিজিটাল মাধ্যমে। ভার্চুয়াল কার্ড ও কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব, তবে প্লাস্টিক কার্ড দেওয়া হবে না। বড় বা মাঝারি শিল্পে ঋণ দেওয়া যাবে না, শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ঋণ অনুমোদিত। পাঁচ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আইপিও আনা বাধ্যতামূলক।
নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ: সম্প্রতি একটি প্রতারক চক্র স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম বলেন, ডিজিটাল লেনদেনে নিরাপত্তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, দক্ষতাও সমানভাবে বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ডিজিটাল ব্যাংক মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকদের জন্য কাজ করবে। সাইবার নিরাপত্তায় বিনিয়োগকে খরচ নয়, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে দেখা উচিত।

