ব্যাংকিং খাতে আমানতের নিরাপত্তা ও জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওমর ফারুক খাঁন। তিনি বলেন, “আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স স্কিম আরও কার্যকর ও বিস্তৃত করা জরুরি, যাতে সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চয় নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর পরিচালন কাঠামো ও আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছ রাখা এবং নিয়মিত অডিটের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা জোরদার ও সাইবার ঝুঁকি প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো সময়ের দাবি।
ওমর ফারুক খাঁন ১৯৮৬ সালে ইসলামী ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন। ব্যাংকিং খাতে তার দীর্ঘ ৩৭ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি জানান, এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংককে আরও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছেন।
আমানতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক প্রবণতায়:
দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক বলে জানান ইসলামী ব্যাংকের এমডি। তিনি বলেন, ২০২৪ সালে যেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭ শতাংশ, চলতি বছরে তা বেড়ে ৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে স্পষ্ট যে আমানত বৃদ্ধির গতি আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, এই প্রবৃদ্ধি মূলত শক্তিশালী ও সুশাসিত ব্যাংকগুলোতেই বেশি। ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে আমানতের দিক থেকে দেশের শীর্ষে রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট আমানত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ। গত এক বছরে ব্যাংকটি ২৪ হাজার কোটি টাকা নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে। ওমর ফারুক খাঁন বলেন, “এই অর্জন আমাদের গ্রাহকদের আস্থা, ভালোবাসা ও শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবার প্রতি বিশ্বাসের ফল।”
তিনি জানান, ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকেই গ্রাহক সন্তুষ্টিকে শুধুমাত্র ব্যবসার কৌশল নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। ফলে ব্যাংকটি অন্যদের তুলনায় আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক ধারণা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত আমরা ব্যাংকিং সেবা বিস্তৃত করেছি।”
ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অতীতে অনিয়ম, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংকিং খাত কঠিন সময় পার করেছে। তৈরি হয়েছিল তারল্য সংকট, বেড়েছিল খেলাপি ঋণ। অনেক ব্যাংকে আমানত উত্তোলনের চাপ তৈরি হয়েছিল।” তবে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি হয়নি বলে জানান তিনি। তার মতে, “আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আমানতকারীদের আস্থা ও শরীয়াহভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। এই আস্থা রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।” তিনি বলেন, “অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা, বিনিয়োগে শরীয়াহসম্মত নীতি অনুসরণ, এবং ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাংকিংসহ আধুনিক গ্রাহকসেবা সম্প্রসারণে আমরা নিয়মিত কাজ করছি।”
ওমর ফারুক খাঁন আরো জানান, বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকে ২৮ প্রকার আমানত স্কিম চালু রয়েছে। সময় ও গ্রাহকের প্রয়োজন অনুযায়ী এসব স্কিম প্রণয়ন করা হয়েছে। “দেশের যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক, এমনকি অভিভাবকের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্করাও আমাদের সেভিংস বা মাসিক কিস্তি স্কিম চালাতে পারেন।”
বিশেষ স্কিমগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- কৃষকদের জন্য মাত্র ১০ টাকায় ফার্মার অ্যাকাউন্ট,
- প্রবাসীদের জন্য মুদারাবা এনআরবি সেভিংস বন্ড,
- শিক্ষার্থীদের জন্য মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট,
- বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য মুদারাবা প্রায়োরিটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট,
- প্রবীণ নাগরিকদের জন্য মুদারাবা সিনিয়র সিটিজেন মাসিক মুনাফা অ্যাকাউন্ট। এছাড়া অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রাহকরা নয় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থ রাখার সুযোগ পাচ্ছেন।
ইসলামী ব্যাংকের এমডি বলেন, “প্রযুক্তি, পেমেন্ট ও নিরাপত্তা খাতে আমরা নিয়মিত উদ্ভাবন করছি। এখন গ্রাহকরা ঘরে বসেই আমাদের ‘সেলফিন’ অ্যাপ ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট খোলা, ব্যালান্স দেখা, টাকা স্থানান্তর ও বিল পরিশোধ করতে পারেন।” গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ব্যাংকটি ‘এমক্যাশ’ মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে বলেও জানান তিনি।
তিনি মনে করেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের আইনি জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, সরকারি সুবিধা বন্ধ রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আহরণকারী। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ব্যাংকটি ৪.৭৩৮ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে, যা প্রায় ৫৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমান। টানা ১৬ বছর ধরে এই সাফল্য ধরে রাখা ব্যাংকটির জন্য একটি বড় অর্জন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সূত্র: মো. ওমর ফারুক খান: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক পিএলসি।

