আর্থিকভাবে দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই একীভূতকরণের অনুমোদন দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ নামে নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটির সংঘবিধি ও সংঘস্মারক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের লাইসেন্স ও কোম্পানি নিবন্ধনের প্রস্তুতিও চলছে। লক্ষ্য—আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নতুন ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু করা। একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলো—এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এই পাঁচ ব্যাংকে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৮ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। শুধু বেতন-ভাতার পেছনেই বছরে ব্যয় হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয় হিসেবেও গুণতে হয় বড় অঙ্কের অর্থ।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন ব্যাংকটি গঠনের উদ্দেশ্য হলো দুর্বল শরিয়াহ ব্যাংকগুলোকে আর্থিকভাবে স্থিতিশীল করা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। তবে বিশাল কর্মীবাহিনী ও পরিচালন ব্যয়ের চাপ সামলে নতুন ব্যাংকটি টেকসইভাবে টিকে থাকতে পারবে কিনা—সে প্রশ্নও রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। আর্থিকভাবে দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করে গঠিত হতে যাচ্ছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বর্তমানে বেসরকারি খাতে কর্মরত এসব ব্যাংকের কর্মীরা সরকারি ব্যাংকের অংশ হয়ে যাবেন। তবে তাদের চাকরির মর্যাদা ও সুবিধা অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের মতো হবে কিনা, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছরের মধ্যে আবারও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। ফলে এখন যদি কর্মীদের সরকারি ব্যাংকের মর্যাদা দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে ব্যাংকটি বেসরকারি খাতে চলে গেলে তাদের অবস্থান কী হবে—তা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলোতে মোট কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮১। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৫ হাজার ৯৯৬ জন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৪ হাজার ৩৯ জন, এক্সিম ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৮৭ জন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২ হাজার ৪৮৬ জন এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৭৩ জন কর্মরত আছেন। পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের একীভূতকরণের পর নতুন ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। পাঁচ ব্যাংকের কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি বছর ব্যয় হয় মোট ১ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের জন্য ব্যয় হয়েছে ৩৯০ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের জন্য ৬৫২ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের জন্য ২০৫ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের জন্য ৫৩০ কোটি এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের জন্য ২০০ কোটি টাকা।
তাছাড়া ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয়ও প্রতি বছর বড় অঙ্কের অর্থ গুনতে হয়। নতুন ব্যাংক গঠনের পর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার দায়িত্বও যুক্ত হবে। এই পরিস্থিতিতে বিশাল ব্যয় সামলাতে সরকার প্রদত্ত মূলধন যথেষ্ট হবে কি না—তাও শঙ্কার বিষয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ব্যাংক সরকারি ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করলে আমানতকারীদের আস্থা বাড়বে। পাশাপাশি লাভজনক খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকের আয়ও বৃদ্ধি পাবে।
নতুন ব্যাংক গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র প্রস্তুত ও আইনি আনুষ্ঠানিকতা বাস্তবায়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ইতিমধ্যেই সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি নামে নতুন ব্যাংকের সংঘবিধি ও সংঘস্মারক তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। ভেটিং সম্পন্ন হলে ব্যাংকের নামের ছাড়পত্র এবং কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধনের জন্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মসমূহের কাছে আবেদন করা হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হবে। সব অনুমোদন পেলে সরকার ব্যাংকে মূলধন সরবরাহ শুরু করবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরাসরি সরকার দেবে। এর ১০ হাজার কোটি টাকা হবে নগদ এবং বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে নতুন ব্যাংকের শেয়ার ইস্যু করা হবে। এটি বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে, যার মাধ্যমে ব্যাংকের গ্রাহক ও অন্যান্য পাওনাদারের একাংশ পাওনা শেয়ারে রূপান্তরিত হবে এবং পরে ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হবে।\ নতুন ব্যাংকের মূলধন সরবরাহ করবে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নতুন ব্যাংকের গঠন ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলে অর্থ বিভাগ থেকে মূলধন সরবরাহ শুরু হবে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন ব্যাংকের পর্ষদ গঠন ও পরিচালনার বিষয়টি তারা তদারকি করবেন। একীভূতকরণের পর পাঁচটি ব্যাংকের সমুদয় সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকের অধীনে আসবে এবং এটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হবে। নতুন ব্যাংক গঠনের পর ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থাকবে। বড় আমানতকারীদের অর্থ ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হবে। অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বণিক বলেন, “আমরা নতুন ব্যাংক গঠনের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি।”
শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য গত সেপ্টেম্বরে আট সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন ও উপসচিব ফরিদ আহমেদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ ও মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজল্যুশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন এবং একই বিভাগের দুই অতিরিক্ত পরিচালক কাজী আরিফ উজ জামান ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন।
কমিটির মূল দায়িত্ব হচ্ছে পাঁচ ব্যাংকের একীভূত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। একীভূতকরণের পর নতুন ব্যাংকের জনবল ও শাখার সংখ্যা ও অবস্থান নির্ধারণের কাজও বাংলাদেশ ব্যাংক করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যমান পাঁচ ব্যাংকের শাখাগুলোকে কোথায় স্থানান্তর করা সম্ভব, সেই সম্ভাব্য তালিকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এসব শাখা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নতুন ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর অর্থ বিভাগ মূলধন সরবরাহ করলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রশাসক নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ বিলুপ্ত হবে এবং বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও পদত্যাগ করবেন। প্রশাসকরা দায়িত্বভার গ্রহণ করে পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবেন।
শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া এগোচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, “সরকার তার কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের দায়িত্বগুলোও গুছিয়ে এনেছে। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই নতুন একীভূত ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করা যাবে।” তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক টিম একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি তদারকি করছে। তবে পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ এখনও কার্যকর হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে আইনি অনুমোদন ও অর্থ ছাড় চূড়ান্ত হলে প্রশাসকরা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব একীভূতকরণের কাজ শেষ করবেন।
পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ (২০২৪ সালের শেষ অবস্থা):
- এক্সিম ব্যাংক: মোট সম্পদ ৬২,৬২৭ কোটি, আমানত ৪২,৮৩৫ কোটি, খেলাপি ঋণ ১৪,৯০৩ কোটি, সঞ্চিতি ঘাটতি ১১,০৮৮ কোটি।
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: মোট সম্পদ ৬৯,২১৭ কোটি, আমানত ৪৩,১৪১ কোটি, খেলাপি ঋণ ৫৫,৯২০ কোটি, সঞ্চিতি ঘাটতি ৪৭,৮৬২ কোটি।
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: মোট সম্পদ ১৯,২২০ কোটি, আমানত ১৩,২৯০ কোটি, খেলাপি ঋণ ১৩,০৮৮ কোটি, সঞ্চিতি ঘাটতি ৮,৮৮১ কোটি।
- সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: মোট সম্পদ ৪৭,৭১৭ কোটি, আমানত ৩০,৯২১ কোটি, খেলাপি ঋণ ২৩,৬৩৩ কোটি, সঞ্চিতি ঘাটতি ২১,৬৫৫ কোটি।
- ইউনিয়ন ব্যাংক: ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট সম্পদ ৩০,৩১৫ কোটি, আমানত ২২,৯৬৭ কোটি। (নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন এখনও প্রকাশিত হয়নি)
পাঁচ ব্যাংকের শাখার সংখ্যা: মোট ৭৬১টি শাখা, যার মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ১৫৫, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ২০৬, গ্লোবাল ইসলামী ১০৫, সোশ্যাল ইসলামী ১৮১, এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ১১৪টি শাখা রয়েছে।

