বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ২০২৫ সাল এখন পর্যন্ত ছিল টিকে থাকার বছর। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ঋণ বিতরণে ধীরগতি আর খেলাপি ঋণের চাপ—সব মিলিয়ে বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুখে এখন একটাই কথা, “এই বছর বেঁচে থাকাই বড় সাফল্য।”
তবু এই ধোঁয়াশার ভেতরেও ছয়টি ব্যাংক এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে। বছরের প্রথম নয় মাসেই তারা মুনাফার দৌড়ে আগের পুরো বছরের আয় ছাড়িয়ে গেছে। এই তালিকায় আছে—ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং ঢাকা ব্যাংক।
এই ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়ার মূল কারণ হলো ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে পাওয়া রিটার্ন। ব্যাংকগুলো যেখানে ঋণ বিতরণে ঝুঁকি কমিয়েছে, সেখানে সরকারী বন্ডে বিনিয়োগে তারা পেয়েছে স্থিতিশীল ও নিরাপদ আয়।
২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে এই ছয় ব্যাংক ট্রেজারি বিনিয়োগ থেকে আয় করেছে প্রায় ৭ হাজার ৪১১ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। তবে ঋণ বিতরণে স্থবিরতা থাকায় তাদের নিট সুদ আয় কমেছে ৩৩ শতাংশ।
শরিয়াভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড একসময় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের রেকর্ড ধরে রেখেছিল। এবারও তারা ইতিবাচক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে, যদিও মুনাফা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৯ কোটি টাকা (গত বছর ছিল ১০৮ কোটি)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ব্যাংক খাতে এখন মোট মন্দ ঋণ ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এই অঙ্ক মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি, আর রাইট-অফ ঋণ ৬২ হাজার কোটি।
বিআইবিএম-এর অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, “ব্যাংকিং বাজারে প্রতিযোগিতা এখন অসম। কিছু ব্যাংক টিকে থাকার জন্য লড়ছে, আর কয়েকটি ভালোভাবে পরিচালিত ব্যাংক বাড়তি আমানত টানছে।”
বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.৩৫ শতাংশে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দেওয়ার চেয়ে পুরনো ঋণ উদ্ধারে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে তারা এখন নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে।
যেভাবে বেড়েছে ছয় ব্যাংকের আয়
-
ব্র্যাক ব্যাংক: নয় মাসে মুনাফা ১,৫৩৬ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ১,৪৩২ কোটি।
-
পূবালী ব্যাংক: মুনাফা বেড়ে ৯০০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৭৬২ কোটি।
-
যমুনা ব্যাংক: মুনাফা ৪১৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি।
-
ব্যাংক এশিয়া: নয় মাসে আয় ৩৫১ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ২৭৭ কোটি। বিনিয়োগ আয় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
-
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক: মুনাফা বেড়ে ৩৮৯ কোটি টাকা, গত বছর ছিল মাত্র ১৬৯ কোটি।
-
ঢাকা ব্যাংক: নয় মাসে আয় ১৪০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ১২৭ কোটি।
অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যেও উন্নতির আভাস আছে। যেমন ইস্টার্ন ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ২৬ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ৬৩০ কোটি, সিটি ব্যাংক ৭২২ কোটি, আর ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২৫৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
অধ্যাপক আহসান হাবিব বলেন, “বর্তমানে ট্রেজারি বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর জন্য স্বস্তির জায়গা। তবে দীর্ঘমেয়াদে শিল্প ও ব্যবসায়িক ঋণ প্রবাহ না বাড়লে অর্থনীতির গতিশীলতা আসবে না।”
একদিকে খেলাপি ঋণের পাহাড়, অন্যদিকে নতুন ঋণের চাহিদা হ্রাস—এই বাস্তবতায় ব্যাংকগুলো এখন নিরাপদ বিনিয়োগকেই বেছে নিচ্ছে। তবুও ব্র্যাক, পূবালী, যমুনা, ব্যাংক এশিয়া, শাহজালাল ও ঢাকা ব্যাংক প্রমাণ করেছে—সঠিক কৌশল, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও বাজারে বিশ্বাস থাকলে কঠিন সময়েও মুনাফা সম্ভব।

