বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বায়ত্তশাসন বাড়ানো এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে সরকারকে ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত ৯ অক্টোবর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে পাঠানো এক আধা-সরকারি চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ সংশোধনের খসড়া তুলে ধরেছেন। চিঠির অনুলিপি অর্থ সচিব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকেও দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বের মর্যাদা বৃদ্ধি, পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠন এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়ায় সংস্কারের সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সংশোধনীর খসড়া উপস্থাপন করা হয়। নীতিগতভাবে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করার জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
গভর্নর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এই সংশোধনীগুলোর মাধ্যমে অতীতের ভুল ও অনিয়ম পুনরাবৃত্তি রোধে শক্তিশালী আইনি ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, পূর্বের সংস্কার প্রচেষ্টা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সময়ই সবচেয়ে উপযুক্ত এবং এটি সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কাছে স্বায়ত্তশাসন শক্তিশালী করতে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ৯টি সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সামগ্রিক সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ পাস হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জোরদারের আহ্বান জানিয়েছিল। সংশোধনী প্রণয়নে তারা প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিয়েছে এবং উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল। যদিও সেই সময়সীমা ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, সংস্কারের যৌক্তিকতা এবং ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি’ স্পষ্ট করতে তিনি চিঠি লিখেছেন। তিনি আরও জানান, গত ১০ অক্টোবর আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। এই কারণে এখনো সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। চলতি সপ্তাহে দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
প্রস্তাবিত সংস্কারগুলি কি উচ্চাভিলাষী, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, “একেবারেই না। বরং অনেক আগেই এগুলো হওয়া উচিত ছিল।” অন্তর্বর্তী সরকার এসব পরিবর্তন কার্যকর করতে পারবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চাইলে অবশ্যই পারবে।” আইএমএফের শর্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা নভেম্বরের আগেই উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করব। সরকার যদি না চায়, সেটা তাদের ব্যাপার।”
বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়ায় সংস্কার প্রস্তাব:
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রস্তাব করেছেন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনা হোক। চিঠিতে তিনি বলেছেন, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের নিয়োগের জন্য সাবেক অর্থ বা পরিকল্পনা মন্ত্রী বা উপদেষ্টা, অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক বা বিদায়ী গভর্নরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হোক। লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। তিনি উল্লেখ করেছেন, এটি আধুনিক ও স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌলিক শর্ত। তিনি উদাহরণ হিসেবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ব্যাংক অব কানাডা, সাউথ আফ্রিকান রিজার্ভ ব্যাংক এবং ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক উল্লেখ করেছেন।
শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপসারণের ক্ষেত্রে চিঠিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত আদালত গঠন করা হোক। এর মাধ্যমে কেবলমাত্র আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপসারণ সম্ভব হবে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তাকে অপসারণ করতে আইনের আওতায় অসদাচরণ বা অক্ষমতার প্রমাণ প্রয়োজন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জোরদারে অত্যাবশ্যক। তিনি উল্লেখ করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে গভর্নরের ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন মানসিকতা ও কর্মদক্ষতার ওপর। বিশেষত, তিনি কীভাবে দায়িত্বগুলো স্বাধীনভাবে ও সততার সঙ্গে পালন করেন তার ওপর নির্ভর করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন প্রস্তাব:
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। সরকারের নিয়োগকৃত পরিচালক সংখ্যা তিন থেকে কমিয়ে এক করা হবে। অন্যদিকে, স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞের সংখ্যা চার থেকে ছয় করা হবে। এতে নিয়ন্ত্রণ ও নীতি নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা আরও শক্তিশালী হবে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বোর্ডে রয়েছেন ১২ জন সদস্য—গভর্নর, দুইজন ডেপুটি গভর্নর এবং নয়জন নন-এক্সিকিউটিভ সদস্য। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে আছেন আটজন সদস্য—গভর্নর, একজন ডেপুটি গভর্নর, তিনজন সচিব, দুজন অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়িক সংগঠনের একজন প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নরের মর্যাদা ও নতুন তদারকি ক্ষমতা প্রস্তাব:
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করা হোক। এটি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এর ফলে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বজায় থাকবে। গভর্নরের মর্যাদা বাড়ালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব শক্তিশালী হবে এবং অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত হবে। নতুন তদারকি ক্ষমতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা, একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিরোধ, ক্রেডিট রেটিং সংস্থার তদারকি, জামানত মূল্যায়ন ও আইনি যাচাই।
এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং স্বার্থের সংঘাত রোধ করা সম্ভব হবে। ফলে ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই নতুন কাঠামো বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি আধুনিক ও সমন্বিত তদারকি কাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এটি অনৈতিক কার্যকলাপ, তথ্য গোপন, স্বজনপ্রীতি এবং একচেটিয়া প্রভাব দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

