বন্দর পরিচালনা, জ্বালানি ও শিপিং খাতে পরিচিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড এখন ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩০৬৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণে রয়েছে। আর্থিক সংকট থেকে বের হতে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এসব ঋণ ১৫ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের আবেদন জানিয়েছে।
কোম্পানির আবেদনের নথিতে দেখা যায়, সাইফ পাওয়ারটেক সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করতে চায়। প্রস্তাব অনুযায়ী, সুদ ও আসল উভয় পরিশোধের ক্ষেত্রে তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ড রাখারও অনুরোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহ ব্যয়ের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে সুদের হার নির্ধারণ করা হোক। পাশাপাশি, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যেন ‘কমপ্রোমাইজ অ্যামাউন্ট’ পরিশোধের শর্ত আরোপ না করা হয়।
এছাড়া কোম্পানিটি অনুরোধ জানিয়েছে, প্রস্তাবিত সুবিধা প্রদানে যদি একক ঋণগ্রহীতা বা বৃহৎ ঋণ এক্সপোজার সীমা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা বিশেষ বিবেচনায় শিথিল করুক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাইফ পাওয়ারটেকের এই আবেদন তাদের তারল্য সংকট ও ব্যাংকঋণ নির্ভর ব্যবসায়িক অবস্থার প্রতিফলন। প্রতিষ্ঠানটি একাধিক খাতে বড় বিনিয়োগ করায় নগদ প্রবাহে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে কোম্পানিটি সময় নিতে চায়, যাতে ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমে। তবে বিদ্যমান ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা অনুযায়ী, এত দীর্ঘ মেয়াদি সুবিধা অনুমোদন পাওয়া কঠিন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত সর্বোচ্চ ১০ বছরের পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়, যা সাইফ পাওয়ারটেকের প্রস্তাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে তাদের আবেদন অনুমোদিত হবে কি না, তা এখন নির্ভর করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনার ওপর।
সাইফ পাওয়ারটেকের ১৫ বছরের পুনঃতফসিল আবেদন:
সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ৩,০৬৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে করা ১৫ বছরের পুনঃতফসিলের আবেদন এখন ব্যাংকগুলোর বিবেচনার অপেক্ষায়। তবে এই প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঋণ পুনর্গঠন নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করতে কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। তবে নীতিতে বলা হয়েছে— কোনো গ্রাহকের ঋণ সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি সময়ের জন্য পুনঃতফসিল করা যাবে এবং ডাউন পেমেন্ট হতে হবে ন্যূনতম ২ শতাংশ। এই সুবিধা ব্যবসায়ীরা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নিতে পারবেন। সেন্ট্রাল ব্যাংকের ‘ঋণ পুনঃতফসিলের মাস্টার সার্কুলার’-এও সর্বোচ্চ ১০ বছরের মেয়াদে পুনঃতফসিল এবং ২.৫ থেকে ৪ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের শর্ত নির্ধারিত আছে। সাইফ পাওয়ারটেকের ১৫ বছরের প্রস্তাব therefore নীতির সঙ্গে মিলছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সাইফ পাওয়ারটেকের আবেদন হাতে এসেছে, তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “এর আগেও কোম্পানিটি নীতিগত ছাড় চেয়েছিল। আমাদের কমিটি কিছু সুবিধা প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেনি।” ওই কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, “এবার পুরো বিষয়টি ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের গ্রাহকের ব্যবসা সম্পর্কে ভালো জানে। ব্যাংকগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার পর আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করব।”
বন্দর পরিচালনা, জ্বালানি ও শিপিং খাতে পরিচিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড এবং এর চারটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান—ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, সাইফ পোর্ট হোল্ডিং লিমিটেড এবং ম্যাক্সন পাওয়ার লিমিটেড—এখন ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৩,০৬৩ কোটি টাকার শ্রেণিকৃত ঋণে জর্জরিত।
ব্যাংকভিত্তিক ঋণের বিভাজন: ঋণের পরিমাণ ব্যাংকভিত্তিকভাবে নিম্নরূপ:
- ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক: ৭৯০ কোটি টাকা,
- ওয়ান ব্যাংক: ২৯০ কোটি টাকা,
- ঢাকা ব্যাংক: ২৪১ কোটি টাকা,
- ন্যাশনাল ব্যাংক: ১,৫৫৪ কোটি টাকা,
- পদ্মা ব্যাংক: ৫৩ কোটি টাকা,
- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক: ১৮ কোটি টাকা,
- প্রিমিয়ার ব্যাংক: ২৭ কোটি টাকা,
- এনসিসি ব্যাংক: ৩৬ কোটি টাকা,
- হাজি ফাইন্যান্স: ৮.৬ কোটি টাকা,
- বাংলাদেশ ফাইন্যান্স: ১০ কোটি টাকা,
- প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স: ৩৪.৬ কোটি টাকা।
ঋণের এই ব্যাপক বিভাজন নির্দেশ করছে, প্রতিষ্ঠানটি একাধিক ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল। ন্যাশনাল ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি ১,৫৫৪ কোটি টাকা ঋণ থাকায় মূল ঝুঁকি সেই ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীভূত। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বড় খেলাপি ঋণ একসঙ্গে পরিশোধে ব্যর্থতা কোম্পানির নগদ প্রবাহ ও ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সম্পত্তি অনাদায়ী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) নিলামে তুলেছে। ব্যাংকের মহাখালী শাখা জানিয়েছে, সাইফ পাওয়ারটেকের প্রায় ৫১৮ কোটি টাকার ঋণ আদায়ের জন্য নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের দুটি বন্ধকি জমি গত ২০ মার্চ নিলামে দেওয়া হয়েছে।
ইউসিবির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, নিলামে তোলা দুটি জমি মোট ঋণের প্রায় ৫৭ শতাংশের বেশি কভার করছে। এছাড়া, নিলামে রাখা সম্পত্তির মধ্যে সাইফ পাওয়ারটেকের পাশাপাশি আরও দুটি কোম্পানি রয়েছে—ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং ম্যাক্সন পাওয়ার লিমিটেড। এই তিনটি কোম্পানির অনাদায়ী ঋণের মোট পরিমাণ ৭৫৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড ২০১৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) মাধ্যমে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয় ৩০ টাকায়, যার মধ্যে ১০ টাকা ছিল অভিহিত মূল্য এবং ২০ টাকা ছিল প্রিমিয়াম।
বন্দর খাতে কার্যক্রম:
সাইফ পাওয়ারটেক ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৭ বছরের ব্যবসায়িক কার্যকাল শেষে চলতি বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনএমসিটি) নিয়ন্ত্রণ নেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পরিচালনাধীন চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। তবে প্রতিষ্ঠানটি এখনও চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) পরিচালনা করছে, যেখানে দুটি জেটি রয়েছে। পাশাপাশি, এনএমসিটি-১ পরিচালনাও অব্যাহত রয়েছে, যেখানে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে পরিবহনের জন্য একটি নির্দিষ্ট জেটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার কমলাপুরে স্থলভিত্তিক কনটেইনার ডিপো (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো–আইসিডি) পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে আসা কনটেইনার গ্রহণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
বন্দর খাত ছাড়াও সাইফ পাওয়ারটেক লজিস্টিকস, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাটারি উৎপাদন এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নির্মাণ খাতেও ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি একাধিক খাতে বিনিয়োগ ও আয়ের উৎস সৃষ্টি করেছে। সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবসা বন্দর ও লজিস্টিক সেবা থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং ও বৈদ্যুতিক খাতে বিস্তৃত। তবে সম্প্রতি ঋণ চাপ ও সম্পত্তি নিলামের ঘটনা দেখাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি পরিচালনার জন্য স্থিতিশীল আর্থিক ভিত্তি বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

