দিনে দিনে কাগুজে টাকার ব্যবহার কমছে, আর নগদবিহীন লেনদেন বাড়ছে। তবে উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে।
দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো নগদ টাকায় লেনদেন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের মাত্র ৩০ শতাংশ আর্থিক মূল্যে হচ্ছে। আর ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনের ভাগ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। ফলে প্রতিবছর নগদ টাকার চাহিদা ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে এবং নগদ ব্যবহারের খরচও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, নগদ টাকার ব্যবস্থাপনায় সরকারের খরচ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। টাকা ছাপানো, সরবরাহ, পুরোনো নোট ধ্বংস এবং ব্যাংকের নগদ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিবছর খরচ হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল বা ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ালে প্রতিবছর এই পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় সম্ভব।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ, সারা দেশে পরিবহন ও বণ্টনে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। রাষ্ট্রের এই বিপুল খরচ কমাতে হলে নগদ ব্যবহারের প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে। এর জন্য ক্যাশলেস বা নগদবিহীন লেনদেন বাড়ানো জরুরি।
গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেন জনপ্রিয় করার কাজ করছে। নীতি-সহায়তা ও প্রযুক্তি অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কিউআর কোড ব্যবহার করতে হবে। ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা—সবার লেনদেন হবে দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ। ক্যাশের ব্যবহার কমলে রাষ্ট্রীয় খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে নগদ লেনদেন কমছে। সেখানে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেশি হচ্ছে। ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডের ব্যবহার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। আধুনিক শহরকেন্দ্রিক নাগরিকরা লেনদেনে স্বচ্ছতা, ঝুঁকিমুক্ততা, কম খরচ ও দ্রুততার জন্য কার্ড ছাড়া নিজেদের অচল মনে করেন। তবে দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা এখনও কম।
নগদবিহীন লেনদেনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং এবং এজেন্ট ব্যাংকিং। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনীতির প্রায় ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত। তাই এখনও দেশের বড় অংশের ব্যক্তিগত লেনদেন নগদ টাকায় হচ্ছে। কার্ডের মাধ্যমে যে লেনদেন হচ্ছে, তা আর্থিক খাতের মোট লেনদেনের তুলনায় কম।
তবুও আশার দিক হলো, দিনকে দিন কার্ডের লেনদেন বাড়ছে। মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসার প্রতিটি অঞ্চলের মানুষকে নগদবিহীন লেনদেনে অভ্যস্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নগদবিহীন লেনদেনের রূপান্তর সময়ের দাবি নয়, বরং অর্থনৈতিক দক্ষতা ও রাজস্ব প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। পুরো দেশে নগদবিহীন অর্থনীতি ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ব্যাংকগুলোকে সেই অনুযায়ী দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, শহরের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা নগদ লেনদেন করতে চায় না। শহরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ সব ধরনের লেনদেন কার্ডের মাধ্যমে করে। তবে গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনও প্রধানত নগদ লেনদেন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ টাকা জমা ও উত্তোলনের কাজে নগদ ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনছে। মোবাইল ফোন এখন আর্থিক লেনদেনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর জন্য সীমাবদ্ধ নেই। এর মাধ্যমে দৈনন্দিন কেনাকাটা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বিল পরিশোধ এবং মোবাইল রিচার্জসহ নানা ধরনের সেবা নেওয়া যায়। ফলে লেনদেন ও গ্রাহকসংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল আর্থিক সেবায় দৈনিক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যাংকের শাখা না থাকলেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের মানুষ ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন। পরিচালন ব্যয় কমাতে ব্যাংকগুলো এখন শাখার পরিবর্তে এজেন্ট ব্যাংকিংকে বিকল্প হিসেবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামীণ মানুষও সহজে টাকা জমা রাখতে পারছে, প্রয়োজন হলে ঋণ নিতে পারছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থও সহজে পৌঁছে যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের কাছে। ফলে ব্যাংকিং সেবা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যন্ত এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যও চাঙা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শক্তিশালী হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। এখন একজন গ্রাহক শাখায় না গিয়েই মোবাইল অ্যাপ, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এটিএম বা কিউআর কোডের মাধ্যমে অধিকাংশ ব্যাংকিং সেবা নিতে পারেন।
তিনি বলেন, লক্ষ্য হলো এমন একটি ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া যেখানে গ্রাহক ফোনের মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে ঋণ আবেদন ও বিল পরিশোধ পর্যন্ত সবই সম্ভব হবে। ব্যাংক যেন গ্রাহকের কাছে আসে, আর গ্রাহককে ব্যাংকে যেতে না হয়। মাহবুবুর রহমান যোগ করেন, তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের কারণে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তরুণরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী সেবা পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, দেশে ডিজিটাল লেনদেন বা ক্যাশলেস পেমেন্ট বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বাংলা কিউআর’ চালু করেছে। দেশের সব ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবাদাতাকে এর মাধ্যমে লেনদেনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, শহরাঞ্চলের মানুষ নগদের পরিবর্তে কার্ডে লেনদেন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো নগদই প্রধান। কিউআর কোড ব্যবহার বাড়ানোই নগদ কমানোর মূল লক্ষ্য।
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম এটিএম স্থাপিত হয়। ১৯৯৬ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দেশে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু করে। এরপর বিভিন্ন ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কার্ডসেবা দেয়। এর মধ্যে ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস, ডিসকভার, জেবিসি ও ইউনিয়ন-পে উল্লেখযোগ্য।
ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহক নগদ টাকা উত্তোলন ছাড়াও বিভিন্ন শপিংমলে কেনাকাটা করতে পারেন। এতে নগদ বহনের ঝামেলা এড়ানো যায়। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে কেনাকাটার ক্ষেত্রে নগদের পরিবর্তে কার্ড ব্যবহারের হার বেশি। ফয়সাল বিন মোর্তজা নামে একজন ক্রেতা বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। তাই আমি সবসময় কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা করি। এতে প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড থাকে এবং কোনো ঝুঁকি নিতে হয় না।”
ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহক বাকিতে পণ্য কিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে পারেন। অর্থাৎ, অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা নির্বিঘ্নে করা যায়। বর্তমানে দেশে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। তারা প্রতি মাসে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করছেন। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি খরচ করছেন সুপার মার্কেট ও রিটেইল আউটলেটে।
ডিজিটাল লেনদেনে সুবিধা ও ঝুঁকি:
ডিজিটাল লেনদেন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, তবে কিছু ঝুঁকিও আছে। নিরাপত্তাহীনতা, প্রতারণা, ফিশিং ও সাইবার হামলার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। কার্ড ব্যবহার করতে গিয়ে মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। যেমন—এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা পাওয়া না যাওয়া, কার্ড আটকে যাওয়া বা পিন চুরি হয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়া অনেক সময় ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে হিডেন চার্জও নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারণা ঠেকাতে মানুষকে সচেতন হতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সফলতা নির্ভর করবে সাইবার নিরাপত্তার শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর। তারা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের জন্য একক সাইবার সিকিউরিটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা উচিত এবং বাধ্যতামূলক অডিট চালু করা উচিত। এছাড়া জালিয়াতি বা সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকারব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে গ্রাহকের আস্থা টেকসই থাকে।
বাংলা কিউআর কোড চালু:
নগদবিহীন লেনদেন বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ‘বাংলা কিউআর’ কোড চালু করেছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং ও আন্তব্যাংক লেনদেন সহজ করতে ইতোমধ্যে ৪৩টি ব্যাংক, ৫টি মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) এবং ৩টি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার এতে যুক্ত হয়েছে। দেশের সাত লাখের বেশি মার্চেন্ট এখন এ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। চ্যালেঞ্জ হলো, এই সেবা শহর ছাড়িয়ে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া। গ্রামে এখনও নগদ টাকাই প্রধান লেনদেনের মাধ্যম। ডিজিটাল লেনদেনকে পুরো দেশে জনপ্রিয় করতে আরও প্রচেষ্টা দরকার।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে নতুন ধারায় বাংলাদেশ:
২০২৩ সালে রাজনৈতিক অনুমোদন সত্ত্বেও নতুন ডিজিটাল ব্যাংক কার্যকর হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার পরিকল্পনা করছে। নতুন নীতিতে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধনের সীমা ৩০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের ১২৫ কোটি টাকার তুলনায় দ্বিগুণ।
ডিজিটাল ব্যাংক কোনো শাখা বা ওটিসি সেবা দেবে না। সব লেনদেন হবে অ্যাপ ও ডিজিটাল মাধ্যমে। ভার্চুয়াল কার্ড ও কিউআর কোড ব্যবহার করে লেনদেন সম্ভব হবে, তবে প্লাস্টিক কার্ড দেওয়া যাবে না। বড় বা মাঝারি শিল্পে ঋণ দেওয়া যাবে না, শুধু ক্ষুদ্র ঋণ অনুমোদিত। এছাড়া পাঁচ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আইপিও আনা বাধ্যতামূলক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উদ্যোগ দেশে নগদবিহীন লেনদেনকে আরও সম্প্রসারণ করবে। ডিজিটাল ব্যাংকিং সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজ ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করবে।

