ট্রাস্ট ব্যাংক সম্প্রতি ৫০ হাজার কোটি টাকার আমানত ছাড়িয়েছে। প্রবাসী আয়ের সাপোর্টে ব্যাংকটি এখন দেশের ব্যাংক খাতে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।
ভবিষ্যতে নতুন ধরনের সেবা চালু করতে ব্যাংকটি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ব্যাংকের বিভিন্ন অর্জন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং দেশের ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আহসান জামান চৌধুরী।
তিনি জানিয়েছেন, ব্যাংকটি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নতুন সেবা ও সুবিধা নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে। প্রবাসী আয় ব্যাংকের প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আর্থিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ব্যাংক খাতের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে এমন ধরনের অর্জন ট্রাস্ট ব্যাংকের জন্য গৌরবের বিষয়।
আহসান জামান চৌধুরী: ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি দেশজুড়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিধিও বেড়েছে। নতুন নতুন শাখা চালুর পাশাপাশি নানাভাবে আমাদের ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের উপস্থিতি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশ শক্তিশালী। সব মিলিয়ে তার সুফল আমরা আমানত প্রবৃদ্ধিসহ নানা খাতে দেখতে পাচ্ছি।
আহসান জামান চৌধুরী: কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে পারছিল না। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে এ নিয়ে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকে রাখতে শুরু করেন। অবশ্যই তার কিছুটা সুফল আমরা পেয়েছি। সত্যিকার অর্থে অনেক গ্রাহকই ট্রাস্ট ব্যাংককে তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চিত আমানতের নিরাপত্তার জন্য শেষ আশ্রয়স্থল মনে করেন। এ কারণে আমরাও বলে থাকি, যদি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট থাকে, তাহলে ট্রাস্ট ব্যাংকও মানুষের কাছে অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে থাকবে।
আহসান জামান চৌধুরী: এককভাবে এই দায় কারও নয়। এই দুরবস্থার জন্য সামগ্রিকভাবে আমাদের সবারই কমবেশি দায় রয়েছে। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও দায় এড়াতে পারেন না। প্রথমত আমি মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বাস্তবতায় ৬১টি ব্যাংক প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এর ফলে পুরো খাতে একধরনের অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। ভালো ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফা করার কারণে অন্য ব্যাংকগুলোর ওপরও বেশি মুনাফার চাপ তৈরি হয়েছে। এই অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বেশি মুনাফার আশায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই সব ধরনের গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। যার ফল এখন আমরা ভোগ করছি। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ যখন বেড়ে যায়, তখন ব্যাংকারদের ওপরও ঋণ বিতরণের চাপ তৈরি হয়। তখন তারা যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দিয়েছে।
আহসান জামান চৌধুরী: আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ব্যাংক খাতের বড় সংকট খেলাপি ঋণ। বর্তমানে ব্যাংক খাতের সার্বিক যে খেলাপি ঋণ, তার একটি বড় অংশই হয়তো আদায় হবে না। ফলে এটি একটি জাতীয় লোকসান। সাধারণ মানুষ ও করদাতার অর্থে এসব লোকসানের দায় শোধ করতে হবে। তার নজির আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে আমি এ-ও মনে করি, ব্যাংক খাতের বর্তমান দুরবস্থার কারণে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। আমরা যদি এই শিক্ষাকে কাজে লাগাই, তবে ব্যাংক খাতে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরবে। আমরা দেখছি সরকার কয়েকটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমি মনে করি, এই উদ্যোগ সফল হলে সেটি ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে বড় সহায়ক হবে। আমরা এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের এই উদ্যোগের সফলতার দিকে তাকিয়ে আছি।
আহসান জামান চৌধুরী: এটা অস্বীকার করা যাবে না যে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। একদিকে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে বিদ্যমান উদ্যোক্তাদেরও ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহ কম। এ কারণে ঋণের চাহিদাও কম। বর্তমানে বেসরকারি সেক্টর ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.২৯%। তাই আমানত যেভাবে বাড়ছে, ঋণ সেভাবে বাড়ছে না। এ জন্য ভালো ব্যাংকগুলোর হাতে এখন যথেষ্ট উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। আবার অতীত অভিজ্ঞতার কারণে ব্যাংকগুলোও এখন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করছে। তাই ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।
ব্যাংকের মূল ব্যবসা যেহেতু সুদ আয়, তাই ঋণ কমে যাওয়ায় অনেক ব্যাংক তাদের উদ্বৃত্ত তারল্য সরকারি বিল বন্ডে বিনিয়োগ করছে। আমি মনে করি, একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে ঋণের চাহিদা আবার বাড়তে শুরু করবে। তখন সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ থেকে সরে এসে ব্যাংকগুলো আবার ঋণের দিকে বেশি মনোযোগী হবে। আমাদের ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমানতের পাশাপাশি আমাদের প্রবাসী আয়েও ভালো প্রবৃদ্ধি আছে। তাই আমরা চেষ্টা করছি উদ্বৃত্ত তারল্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করে আয় বাড়ানোর।
আহসান জামান চৌধুরী: ট্রাস্ট ব্যাংকের কোথাও কোনো নিজস্ব এক্সচেঞ্জ হাউস নেই। তারপরও আমরা এ খাতে যথেষ্ট ভালো করছি। কারণ, এখন পৃথিবীজুড়েই ব্যাংকিংয়ের বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে ডিজিটাল ব্যাংকিং তথা ফিনটেক। পৃথিবীর সব বৃহৎ ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। তাদের মাধ্যমে রিয়েল টাইমে (তাৎক্ষণিকভাবে) আমরা প্রবাসী আয় সংগ্রহ করি। প্রবাসী আয় বাড়াতে ডিজিটাল ব্যাংকিং আরও উন্নত করতে আমরা কাজ করছি। তাই আশা করছি ভবিষ্যতে আমাদের প্রবাসী আয় আরও বাড়বে। এখন আমরা গর্ব করে বলতে পারি, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ট্রাস্ট ব্যাংকও ইতিমধ্যে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
আহসান জামান চৌধুরী: শুরুতে ৮-১০ বছর ট্রাস্ট ব্যাংকের কার্যক্রমের বড় অংশই ছিল সেনানিবাসকেন্দ্রিক। সেনানিবাসের বাইরে ট্রাস্ট ব্যাংকের কার্যক্রম বিস্তৃত হতে শুরু করে মূলত ২০০৮ সালের পর থেকে। ২০১০ সালের পর এটির ব্যাপকতা বাড়তে শুরু করে। এখন দেশের অনেক জেলা-উপজেলায় আমাদের শাখা রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ আমাদের অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতোই মনে করে। ৮-১০ বছর ধরে নানা উদ্যোগ ও চেষ্টার ফলে আমরাও এখন সর্বসাধারণের ব্যাংক হয়ে উঠতে পেরেছি। এখন সব শ্রেণির গ্রাহকের ব্যাংক হিসেবে আমরা আমাদের কর্মকাণ্ডকে আরও বিস্তৃত করছি। এর মধ্যে দেশজুড়ে আমাদের শাখা-উপশাখার সংখ্যা ১৩০ ছাড়িয়ে গেছে।
আহসান জামান চৌধুরী: আমাদের ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ট্রাস্ট। আমরা সব সময় আমাদের ব্যাংকের নামের এই সার্থকতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। সেই সঙ্গে আমাদের আরেকটি বড় শক্তির জায়গা আমাদের পরিচালনা পর্ষদ। দেশের অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় ট্রাস্ট ব্যাংকের পর্ষদ অনন্য। আমাদের ব্যাংকে একক কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই। ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছে ‘আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’। সেই মালিকানার অংশ হিসেবে পর্ষদে কারা প্রতিনিধিত্ব করবেন, তার একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। ব্যক্তি নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই এই প্রতিনিধিত্ব নির্ধারিত হয়। এটি ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরির ক্ষেত্রেও বড় সহায়ক।
আহসান জামান চৌধুরী: আমরা ছোট ছোট উদ্যোক্তা ও মানুষের দৈনন্দিন ঋণের চাহিদা মেটাতে ন্যানো ঋণ চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। খুব শিগগির এ ঋণ কার্যক্রম শুরু করা হবে। এ জন্য ইতিমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আগামী দিনে আমাদের ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ন্যানো ঋণের দিকেই বেশি ফোকাস। বড় ঋণের ক্ষেত্রে আমাদের এখন আগ্রহ কম। যেসব বড় ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তার বেশির ভাগই সরকারি বড় বড় অবকাঠামো খাতের প্রতিষ্ঠানকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় চাহিদা মেটাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানকেই বড় ঋণ দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র: প্রথম আলো

