দেশের ব্যাংকিং সেবা পুরোপুরি ডিজিটাল করার লক্ষ্য নিয়েই শুরু হচ্ছে অ্যাপনির্ভর ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া। শাখা, এটিএম বা কোনো অবকাঠামো ছাড়াই গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা যেকোনো সময়ে ব্যাংকিং সেবা পাবেন। ইতিমধ্যে দেশি ও বিদেশি ১২টি প্রতিষ্ঠান নতুন প্রজন্মের এই ব্যাংক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের আবেদন করেছে।
নতুন যুগের আবেদনকারীরা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন: ব্রিটিশ বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, ডিজিটাল ব্যাংকিং অব ভুটান-ডিকে, আমার ডিজিটাল ব্যাংক-২২ এমএফআই, ৩৬ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, বুস্ট-রবি, আমার ব্যাংক (প্রস্তাবিত), অ্যাপ ব্যাংক-ফার্মারস, নোভা ডিজিটাল ব্যাংক (বাংলালিংক ও স্কয়ার), মৈত্রী ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, উপকারী ডিজিটাল ব্যাংক, মুনাফা ইসলামী ডিজিটাল ব্যাংক-আকিজ এবং বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক। আবেদনের শেষ সময় ছিল ২ নভেম্বর।
২০২৩ সালের ১৪ জুন প্রণীত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য ন্যূনতম ৩০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোম্পানি আইন অনুসারে পরিচালিত হতে হবে এবং প্রচলিত ব্যাংকের মতোই নগদ জমা অনুপাত (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা অনুপাত (এসএলআর) বজায় রাখতে হবে।
ডিজিটাল ব্যাংকগুলো বড় বা মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে পারবে না এবং কোনো ধরনের ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। তারা শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ঋণ, খুচরা লেনদেন এবং ডিজিটাল সেবা প্রদান করবে। অনুমোদনের পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের আইপিও আনার শর্ত রয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগের সমপরিমাণ হতে হবে।
অ্যাপেই পুরো ব্যাংকিং:
প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণ অ্যাপনির্ভর হবে। কোনো শাখা বা এটিএম থাকবে না। গ্রাহকরা ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও মোবাইল লেনদেনের মাধ্যমে সব সেবা পাবেন। প্লাস্টিক কার্ডের পরিবর্তে সব লেনদেন হবে ডিজিটাল উপায়ে। এছাড়া তারা অন্য ব্যাংকের এটিএম বা এজেন্ট সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। সব সেবা পরিচালিত হবে বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম রেগুলেশন, ২০১৪-এর আওতায়, যা লেনদেনকে নিরাপদ ও স্বচ্ছ রাখবে।
যোগ্যতার কঠোর মানদণ্ড:
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্য ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হতে হবে অন্তত ১৫ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের অন্তত ৫০ শতাংশ সদস্যকে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং, সাইবার নিরাপত্তা ও উদীয়মান প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যাংকের লক্ষ্য হলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া।’ তিনি আরও জানান, এসব ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং ক্যাশলেস সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক আবেদনগুলো যাচাই করবে। এরপর টেকনিক্যাল ও বিজনেস কমিটি যোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। মানদণ্ডে উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ পেয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারবে। চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে নতুন বছরের প্রথম দিকে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রথাগত ব্যাংকে ডিজিটাল সেবা হালনাগাদ রাখা কঠিন। তাই স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক সময়ের দাবি। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে দক্ষ জনবল, তথ্য-উপাত্ত ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা, বিপণন কৌশল এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্ত রাখা।’

