প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে দেশের শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংকের দায়দায়িত্ব নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাঁচটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসকরা দায়িত্ব নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কর্মকাল শেষ হয়েছে।
প্রশাসকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চারজন করে কর্মকর্তা ব্যাংক পরিচালনায় নিযুক্ত করেছে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলো পরিচালনা করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাই। দুর্বল পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া ও সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে গতকাল বিকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলন হয়। অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এ ব্যাংকগুলো একীভূত হয়ে যে নতুন ব্যাংক গঠিত হবে, সেটি দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মূলধন কাঠামোর ব্যাংক হবে। ব্যাংকটির মালিকানা হবে সরকারি। তাই আমানতকারী বা কর্মকর্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হতে এক থেকে দুই বছর সময় লাগতে পারে।”
শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। উদ্যোক্তা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে এসব ব্যাংকের শেয়ার রয়েছে। তবে এই শেয়ারগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এস ব্যাংকের ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি যে প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ারের মূল্য ঋণাত্মক ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী শেয়ারধারীরা কিছুই পাবেন না। তাদের শেয়ার শূন্য হয়ে গেছে। তবে যারা বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন, তারা টাকা বা শেয়ার পাবেন।”
এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক একীভূত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে এক্সিম ছাড়া বাকি চারটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। নতুন ব্যাংকের নাম হবে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরুর পর চূড়ান্ত রূপ দিতে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে।
প্রশাসক নিয়োগের কারণে পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডিদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডেকে নিয়ে বৈঠক করা হয়। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বণিক জানান, “গণ-অভ্যুত্থানের পর এ পাঁচটি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। আমাদের দায়িত্বের জন্য গভর্নর ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রশাসক নিয়োগ বিষয়েও অবহিত করা হয়েছে। বৈঠকের পর আমরা প্রশাসক নিয়োগের চিঠি পেয়েছি। এখন থেকে এই পাঁচ ব্যাংকের কোনোটিতে পর্ষদ কার্যকর থাকবে না। দুটিতে পূর্ণাঙ্গ এমডি ছিলেন, বাকি তিনটির এমডি ভারপ্রাপ্ত। প্রশাসক নিয়োগের ফলে পূর্ণাঙ্গ এমডিরা চাকরি হারাচ্ছেন, তবে ভারপ্রাপ্তরা ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে থাকবেন।”
এক বৈঠক অংশগ্রহণকারী চেয়ারম্যান জানান, “আমরা গভর্নরের কাছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো শেয়ারহোল্ডারের দায়িত্ব নেবে না। কারণ ব্যাংকগুলোর শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক। যেসব পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডারের কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা কিছুই পাবেন না। তবে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলে সরকার বা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের উদ্যোগকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাগত জানাবে।” শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হতে যাচ্ছে। পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন:
- এক্সিম ব্যাংকে শওকাতুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক
- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে মুহাম্মদ বদিউজ্জামান দিদার, নির্বাহী পরিচালক
- সোশ্যাল ইসলামীতে মো. সালাহ উদ্দিন, নির্বাহী পরিচালক
- গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে মো. মোকসুদুজ্জামান, পরিচালক
- ইউনিয়ন ব্যাংকে মো. আবুল হাসেম, পরিচালক
প্রশাসকদের সঙ্গে সব ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও চারজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন। প্রশাসকদের প্রথম কাজ হবে পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয় করা। সেনাকল্যাণ ভবনে স্থাপিত কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এই তথ্যগুলো সমন্বয় করবেন।
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কার্যক্রম আগের মতো চলবে। একীভূতকরণের কাজও এগিয়ে যাবে। প্রত্যেক আমানতকারী চাইলে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত তুলে নিতে পারবেন। তবে সরকারি ব্যাংক হওয়ায় প্রয়োজন ছাড়া তারা বড় পরিমাণ টাকা তোলার দরকার নেই। বড় আমানতকারীরা কখন টাকা তুলতে পারবেন, তা পরে গেজেটের মাধ্যমে জানানো হবে। যদি সব আমানতকারী একসঙ্গে টাকা তুলতে চান, তাহলে পৃথিবীর কোনো ব্যাংক টিকতে পারবে না।”
আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জানা গেছে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ ব্যাংকের মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ২ লাখ ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূলধন, বিতরণকৃত ঋণসহ অন্যান্য সম্পদ অন্তর্ভুক্ত। ব্যাংকগুলোর ৭৫ লাখ আমানতকারীর ১ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৪ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল। এর বিপরীতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৯২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৭৬ শতাংশ।
পাঁচ ব্যাংকের শাখা-প্রসার হলো: ৭৬১টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও ৯৭৫টি এটিএম বুথ। খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ হার রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে ৯৮ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামীর ৯৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামীর ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীর ৬২.৩০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮.২০ শতাংশ। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর লাখ কোটি টাকারও বেশি সঞ্চিতি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পাঁচ ব্যাংকে ১৮,০৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। ২০২৪ সালে কেবল বেতন-ভাতায় ব্যাংকগুলোর ব্যয় হয়েছে ১,৯৭৭ কোটি টাকা।
শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হয়ে নতুন সরকারি ব্যাংক ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ গঠিত হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সরকারের অংশ থাকবে ২০ হাজার কোটি টাকা, যার ১০ হাজার কোটি নগদ এবং বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে।
পাঁচ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে নতুন ব্যাংকের শেয়ার ইস্যু করা হবে। এটি বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের গ্রাহক ও অন্যান্য পাওনাদারের পাওনার অংশও শেয়ারে রূপান্তরিত হবে। নতুন ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে মূলধন সরবরাহ করা হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এদিকে, পাঁচ ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর বর্তমান দুরবস্থার জন্য সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা দায়ী নয়। কমিশন জানিয়েছে, সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যালান্সশিটের সম্পদ মূল্যায়ন, লাইসেন্স, শাখা নেটওয়ার্ক, গ্রাহক, জনবল, সেবা প্রদান পদ্ধতি এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু বিবেচনা করে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, দায়ী ব্যক্তিদের শেয়ার বাদে অন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থকে ন্যূনতম স্বার্থমূল্য হিসেবে বিবেচনা করে একীভূতকরণের অনুপাত নির্ধারণ করতে হবে। শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থমূল্য ঘোষণা না করে বা একীভূতমূল্য প্রকাশ না করে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তালিকাভুক্তি বাতিল করা যাবে না।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বণিক বলেন, “এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে কমিশনের পক্ষ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংক্রান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।”

