পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও) প্রবিধান ২০২৫-এর পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পিএসওদের জন্য আর্থিক ও পরিচালনগত বাধ্যবাধকতা আরও কঠোর করা হয়েছে। বিশেষ করে ট্রাস্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে (টিএসএ) কোনো ঘাটতি হলে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি পিএসওকে প্রতিদিনের শেষে তাদের টিএসএ অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালান্স রাখতে হবে, যাতে সব বকেয়া মার্চেন্ট লায়বিলিটি কাভার হয়।
যদি কোনো ঘাটতি দেখা দেয়, তবে বর্তমান স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট—যা বর্তমানে ১১.৫০ শতাংশ—অথবা ৩০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি কম, সেটি জরিমানা হিসেবে আরোপ করা হবে।
এই ঘাটতির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পরিচালক, সিইও ও ট্রেজারি কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। যদি ঘাটতি ১৪ দিনের বেশি থাকে, তবে প্রতিদিন অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি জনসাধারণের মতামতের জন্য খসড়াটি প্রকাশ করেছে। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শেষে একটি কমিটি প্রবিধানটি চূড়ান্ত করবে।
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন এই প্রবিধান ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস অ্যাক্ট ২০২৪’-এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
পিএসও মূলত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে—পেমেন্ট নির্দেশনা গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণ, ক্লিয়ারিং ও দায় নিষ্পত্তিতে সহায়তা করে। তবে তারা কোনোভাবেই ই-মানি ইস্যু করতে পারে না। সব লেনদেন নিষ্পত্তি করতে হয় তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে।
বর্তমানে দেশে কার্যরত পিএসওগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এসএসএলকমার্জ লিমিটেড, সূর্যপে, আইটি কনসালট্যান্টস লিমিটেড, আমারপে ও পে-স্টেশন। তাদের সেবার মধ্যে রয়েছে মার্চেন্ট অ্যাকোয়ারিং, এটিএম অ্যাকোয়ারিং ও পেমেন্ট সুইচিং।
লাইসেন্সিং ও মূলধনের নতুন কাঠামো
পিএসও হিসেবে লাইসেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে নিবন্ধিত হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন’-এ পেমেন্ট সেবা প্রদানের বিষয়টি স্পষ্ট থাকতে হবে।
লাইসেন্স প্রক্রিয়া দুই ধাপে সম্পন্ন হবে—প্রথমে অনাপত্তিপত্র (এনওসি), পরে মূল লাইসেন্স। আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা এবং লাইসেন্স ফি ৫ লাখ টাকা। লাইসেন্স পাওয়ার পর ১২০ দিনের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
সেবার ধরন অনুযায়ী মূলধনের পরিমাণও নির্ধারিত।
- ডিজিটাল মার্চেন্ট অ্যাকোয়ারিং সেবার জন্য ন্যূনতম ১ কোটি টাকা।
- এটিএম বা সিআরএম সেবার জন্য ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত মূলধন থাকতে হবে।
এছাড়া, মার্চেন্ট অ্যাকোয়ারিং ও পেমেন্ট ইনিশিয়েশন সেবায় গত ১২ মাসের গড় মাসিক লেনদেনের ০.৩ শতাংশ সমপরিমাণ কার্যকর মূলধন রাখতে হবে। সুইচিং, এটিএম ও কার্ড স্কিম সেবায় এই হার হবে ০.১ শতাংশ।
খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি পিএসওতে অন্তত পাঁচ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ থাকতে হবে, যার দুই-তৃতীয়াংশ নন-এক্সিকিউটিভ পরিচালক। পর্ষদের চেয়ারম্যানও নন-এক্সিকিউটিভ হতে হবে।
পর্ষদ সদস্যদের অন্তত পাঁচ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তারা ঋণখেলাপি হতে পারবেন না বা অন্য কোনো পিএসওতে একযোগে পদে থাকতে পারবেন না।
সিইওর থাকতে হবে স্নাতক ডিগ্রি এবং ফিন্যান্স, পেমেন্ট, ফিনটেক, আইটি বা টেলিকম খাতে অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে দুই বছর সিনিয়র নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক। সিইও নিয়োগের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ও প্রার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে হবে।
পিএসওগুলোকে সব মার্চেন্টের কেওয়াইসি যাচাই করতে হবে এবং লিখিত নিষ্পত্তি চুক্তি রাখতে হবে। বিক্রির অর্থ পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। নগদ নিষ্পত্তি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এটিএম ও সিআরএম বুথ নিরাপদ ও সহজপ্রবেশযোগ্য স্থানে স্থাপন বাধ্যতামূলক। শহরে ১২ ঘণ্টা ও গ্রামে ২৪ ঘণ্টার বেশি ডাউনটাইম চলবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রতিটি পিএসওকে তারল্য, পরিচালন, কাস্টডি, জালিয়াতি ও অর্থপাচার ঝুঁকি মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পর্ষদ ঝুঁকির সহনশীলতা নির্ধারণ করবে এবং ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন ও তদারকি করবে।
স্পন্সর শেয়ারহোল্ডাররা প্রথম পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবেন না।
গ্রাহকদের ওপর চার্জ আরোপের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। সব লেনদেনের তথ্য অন্তত ১২ বছর সংরক্ষণ করতে হবে।
কোনো বড় ধরনের পরিচালনাগত ত্রুটি হলে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে এবং তথ্য ফাঁস বা ডেটা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে।

