আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এই মাশুলের ফল হিসেবে ব্যাংক খাত এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। খেলাপি ঋণ, নিরাপত্তা সঞ্চয় বা প্রভিশন ঘাটতি এবং মূলধনের অভাব একসাথে বেড়েছে।
চলতি বছরের জুনে দেশের ২৪টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এদের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। তুলনায় মার্চে ২৩ ব্যাংকের ঘাটতি ছিল এক লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। নতুন করে এনআরবিসি ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ঘাটতিতে পড়েছে। তবে বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক ঘাটতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, “গত বছরের ডিসেম্বরেও আমাদের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। এখন তা সাড়ে ২৮ শতাংশে বেড়ে গেছে। বড় অঙ্কের নিরাপত্তা সঞ্চয় বা প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। প্রকৃত চিত্র বের করার পর আমরা উত্তরণের চেষ্টা করবো।”
ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, “গত সরকারের সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণের নামে বের করা হয়েছিল। তখন এসব ঋণ খেলাপি হলেও খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব লুকানো খেলাপি ঋণ সামনে এসেছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়েছে।” বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চয় রাখতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এর ফলে মূলধনের অভাব তৈরি হচ্ছে, যা দেশের পুরো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের অনুযায়ী, জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন ঝুঁকিজনিত সম্পদের অনুপাত বা সিআরএআর নেমে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৪৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এটি ন্যূনতম ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। মার্চ শেষে সিআরএআর ছিল ছয় দশমিক ৭৪ শতাংশ। সিআরএআর হলো একটি ব্যাংকের মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত, যেখানে সম্পদের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী হিসাব নির্ধারণ করা হয়।
জুনে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ১০টি বেসরকারি ব্যাংক, আটটি ইসলামি ব্যাংক ও দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক মূলধনের ঘাটতিতে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি হয়েছে জনতা ব্যাংকে। জুন শেষে এই ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এর পরে অগ্রণী ব্যাংকের সাত হাজার ৬৯৮ কোটি, রূপালী ব্যাংকের চার হাজার ১৭৩ কোটি ও বেসিক ব্যাংকের তিন হাজার ৭৮৩ কোটি টাকার ঘাটতি।
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, “একসময় বেসিক ব্যাংক ভালো ছিল। পরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।” তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, “বেসিক ব্যাংক বাঁচানো লাভজনক নয়। দীর্ঘদিন লোকসান ও ধুঁকে ধুঁকে চলার চেয়ে বন্ধ করাই ভালো।”
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূলধন ঘাটতি রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকে। জুনে এর ঘাটতি দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকের ছয় হাজার ৭৭৫ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের পাঁচ হাজার ৬১৯ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের চার হাজার ৫১ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এক হাজার ৮৭৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের এক হাজার ৬৪০ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের এক হাজার ৩৮৫ কোটি, এনআরবিসি ব্যাংকের ৩১৬ কোটি, সিটিজেন ব্যাংকের ৮৬ কোটি ও সীমান্ত ব্যাংকের ৪৫ কোটি টাকা।
শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। জুন শেষে এই ব্যাংকের ঘাটতি ২১ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। এরপর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ১৮ হাজার ৫০৪ কোটি এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘাটতি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক-এ, যা ৫ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দুই হাজার ৭৯ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এক হাজার ৯৭৫ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৯০১ কোটি এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ২৫৪ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি ব্যাংকের এত বড় ঘাটতি শুধুমাত্র এক ব্যাংকের সমস্যা নয়। এটি পুরো ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতার ওপর বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। এর সঙ্গে অন্যান্য বিশেষায়িত ও ইসলামি ব্যাংকের ঘাটতি মিলিয়ে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে মূলধনের অভাব এবং ঝুঁকিজনিত সম্পদের অপ্রতুলতা উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে।

