বাংলাদেশও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোর মতো ‘ওপেন ব্যাংকিং’ চালু করতে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো গ্রাহক একটি ব্যাংকে হিসাব থাকলেও তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অন্য ব্যাংকের সেবা নিতে পারবেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, উদাহরণ হিসেবে ধরলে, যদি কোনো গ্রাহকের সিটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে, তবে সেই ব্যাংকের লেনদেনের ইতিহাস অনুযায়ী তিনি ইস্টার্ন ব্যাংক থেকেও সেবা নিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে ইস্টার্ন ব্যাংক তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সেবা দেবে।
গ্রাহকরা নিজেদের সম্মতিতে তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক বা অ্যাপের মাধ্যমে আর্থিক তথ্য শেয়ার করতে পারবেন। এতে ঋণ গ্রহণ, বিল পরিশোধ, ব্যয় বিশ্লেষণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য একই প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এতে সেবা আরও সহজ, খরচ কমবে এবং রিয়েল-টাইম ডেটার মাধ্যমে দ্রুত ঋণ অনুমোদন ও ব্যক্তিগত আর্থিক সমাধান দেওয়া সম্ভব হবে।
গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম বাংলাদেশ ফিনটেক সামিটে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের পরিচালক শরাফত উল্লাহ খান বলেন, “ব্যাংক, ফিনটেক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় খুব শিগগিরই বাংলাদেশে ‘ওপেন ব্যাংকিং’ চালু করা সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, এটি বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো, পেমেন্ট ইনিশিয়েশন সার্ভিস ও ডিজিটাল ব্যাংকের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সভায় লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং সীমিত কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “ওপেন ব্যাংকিং চালু হলে ব্যাংকগুলো তৃতীয় পক্ষের ফিনটেকের সঙ্গে কাজ করে গ্রাহকসেবা উন্নত করতে পারবে। সঠিক চ্যানেল তৈরি ও কর্মীদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ বাড়ালে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানো সম্ভব।”
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় ওপেন ব্যাংকিং ইতোমধ্যে নিয়মিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার অংশ। সেখানে গ্রাহক নিজের তথ্যের পূর্ণ অধিকার রাখেন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য একত্র করে এক প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করতে পারেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সফল বাস্তবায়নের জন্য গ্রাহকের সম্মতি, সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্য সুরক্ষা আইন নিশ্চিত করা জরুরি।” তিনি আরও জানান, “ওপেন প্ল্যাটফর্ম চালু হলে নতুন ফিনটেক প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবনী আর্থিক সমাধান আনতে পারবে এবং ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতায় আরও সক্ষম হবে।”
গ্লোবাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড টেকনোলজি নেটওয়ার্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী সপ্নেন্দু মোহান্তি বলেন, ‘ওপেন’ শব্দটি অনেক সময় উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন দেশ এটি ভিন্নভাবে গ্রহণ করেছে। যুক্তরাজ্যে সাধারণ এপিআই–এর মাধ্যমে তথ্য উন্মুক্ত রাখা বাধ্যতামূলক, ভারতে সরকার-সমর্থিত অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিগেটর মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে, আর সিঙ্গাপুরে হাইব্রিড, উদ্ভাবননির্ভর ও বাজারচালিত পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ‘ওপেন ব্যাংকিং গাইডলাইন’ এবং মানসম্মত এপিআই প্রোটোকল প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে, যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দিকনির্দেশনা দেবে।
ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে ওপেন ব্যাংকিং:
সিঙ্গাপুরে ‘ওপেন ব্যাংকিং’ চালু হয়েছে মোনেটারি অথরিটি অব সিঙ্গাপুর (এমএএস)–এর তত্ত্বাবধানে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক ও ফিনটেক কোম্পানির মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এমএএস ‘এপিআই এক্সচেঞ্জ (এপিআইএক্স)’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদে গ্রাহকের তথ্য শেয়ার করতে পারে। সিঙ্গাপুরের ওপেন ব্যাংকিং কাঠামোয় স্ট্যান্ডার্ডাইজড এপিআই নীতি বাধ্যতামূলক। এর ফলে উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। যদিও এটি সরকার–নিয়ন্ত্রিত, তবুও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্ভাবন সহায়ক হিসেবে স্বীকৃত।
ভারতে ওপেন ব্যাংকিং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) অনুমোদিত অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিগেটর (এএ) ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এখানে গ্রাহকের সম্মতিতে অনুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো—ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্স কোম্পানি (এনবিএফসি) ও বিমা প্রতিষ্ঠান—ডেটা শেয়ার ও অ্যাক্সেস করতে পারে। ভারতের এই কাঠামো ডিজিটাল অবকাঠামো ইন্ডিয়া স্ট্যাকের অংশ। এটি দ্রুত ঋণ মূল্যায়ন, ডিজিটাল লেনদেন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও নিয়মভিত্তিক ওপেন ব্যাংকিং মডেল হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংক, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি), পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও) এবং ই-মানি ইস্যু সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো ভবিষ্যতে ‘ওপেন ব্যাংকিং’ বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করবে। ইতোমধ্যেই ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল ট্রানজাকশন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) ও বাংলা কিউআর ব্যাংক ফিনটেকের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ওপেন ব্যাংকিং চালু হলে গ্রাহকরা একক অ্যাপের মাধ্যমে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, পেমেন্ট ও বিনিয়োগ সেবা নিতে পারবেন। এতে গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

