নমিনি আর উত্তরাধিকারী একই ব্যক্তি না হলে কী হয়? তাঁরা কি একে অপরের বিরুদ্ধে যেতে পারেন? মারা যাওয়া ব্যক্তির ব্যাংক অর্থ কাকে যায়? যদি দুই ধরনের নীতি থাকে, তখন কী হয়?
এই প্রশ্নগুলো সামনে আসে সম্প্রতি মেট্রোরেল দুর্ঘটনায় আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু নিয়ে। গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে কালামের মৃত্যু হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। সেখানে বলা হয়, কালামের ব্যাংক হিসাবের নমিনি তাঁর বোন। তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা নমিনি না হওয়ায় বঞ্চিত হচ্ছেন।
তারপরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, নমিনি কে হতে পারেন এবং তাঁদের অধিকার কতটুকু। মারা যাওয়া ব্যক্তির সম্পত্তি কি নমিনির হবে, নাকি উত্তরাধিকারের কাছে যাবে—এ বিষয় হাইকোর্টের রায় এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজনীন নাহার বলেন, “নমিনি আর উত্তরাধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় অনেক মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আদালতে বহু মামলা রয়েছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।”
নমিনি ও উত্তরাধিকারের অধিকার:
নমিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁকে আমানতকারী তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ গ্রহণের জন্য মনোনীত করেন। আমানতকারীর মৃত্যু হলে নমিনি সেই টাকা তুলতে পারেন। তবে নমিনি কেবল একজন প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করেন। যদি নমিনি নিজে উত্তরাধিকারী হন, তিনি আইন অনুযায়ী নিজের প্রাপ্য অর্থ পাবেন। অন্যথায় তাঁর দায়িত্ব হবে—টাকা মারা যাওয়া আমানতকারীর উত্তরাধিকারীর কাছে হস্তান্তর করা।
এখানেই সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনে উত্তরাধিকার কে, তা স্পষ্ট নয়। ব্যাংকের কাছে যিনি গুরুত্বপূর্ণ, তিনি হলেন নমিনি। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারা অনুযায়ী, আমানতকারী মারা গেলে তাঁর অ্যাকাউন্টের টাকা নমিনির কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ব্যাংক সেই অর্থ নমিনিকে পরিশোধ করবে। যদি নমিনি নাবালক হন, আমানতকারী আগে থেকেই নির্ধারণ করতে পারেন, কে সেই টাকা গ্রহণ করবেন। যদি কোনো ওয়ারিশ সেই অর্থের মালিকানা দাবি করেন, নমিনিকে আদালতে যেতে হবে অর্থাৎ ব্যাংক মারা যাওয়া আমানতকারীর অর্থ বুঝিয়ে দিলে, নমিনি উত্তরাধিকারের কাছে না দিলে ব্যাংকের কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকি বলেন, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আমানতকারীকে অবশ্যই নমিনি ঠিক করতে হয়। এক বা একাধিক নমিনি হতে পারেন। আমানতকারী ঠিক করেন, কোন নমিনি কত শতাংশ পাবেন। ব্যাংক নিজে নমিনি বা উত্তরাধিকারের খোঁজ নেবে না। নমিনি আসলে সব তথ্য ঠিক থাকলে ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী অর্থ বুঝিয়ে দেবে।
নমিনি অনুপস্থিত থাকলে ব্যাংক মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি কীভাবে হস্তান্তর করবে? শাহরিয়ার সিদ্দিকি বলেন, যদি নমিনি মারা যান বা নিখোঁজ থাকেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যাংক সম্পত্তি উত্তরাধিকারীর কাছে হস্তান্তর করবে। ব্যাংকের সঙ্গে উত্তরাধিকারের কোনো সম্পর্ক থাকে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক নমিনিকে ব্যাংক টাকা দেবে না। সেই ক্ষেত্রে নমিনিকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ২০১৬ সালে হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের হিসাবধারী মারা গেলে টাকা নমিনির পরিবর্তে উত্তরাধিকারীর কাছে যাবে।
কালামের নমিনি ও উত্তরাধিকারের বাস্তব চিত্র:
নিহত আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন খান ও দুই সন্তান আছে। তাঁর দুই সন্তানই অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তারা বাবার কোনো অর্থ পাবেন না। কালামের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। সেখানে বলা হয়, কালামের ব্যাংক হিসাবের নমিনি তাঁর বোন। তবে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে, বোন নমিনি—এই তথ্য সঠিক নয়। কালামের স্ত্রী আইরিন খান বলেন, তিনি এমন কোনো তথ্য কাউকে জানাননি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর স্বামীর তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল, তবে সেগুলোর নমিনি কে তা তিনি জানেন না।
অন্যদিকে কালামের বোন লাইজু আক্তার বলেন, ভাই বিয়ে করার আগে যেসব অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, সেগুলোতে বোনদের নমিনি ছিলেন। বিয়ের পর নমিনি পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে ভাইয়ের জমি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নমিনি তার স্ত্রী। কালামের মৃত্যুর পর পরিবারকে সহযোগিতার জন্য তার স্ত্রীর নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এই অ্যাকাউন্টে নমিনি করা হয়েছে কালামের মা ও তাঁর ছয় বছর বয়সী বড় সন্তানকে।
নমিনি ও উত্তরাধিকারী কীভাবে নির্ধারণ হয়, সে বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রমজান আলী সিকদার বলেন, বিষয়টি এখনো আইনিভাবে চূড়ান্ত হয়নি। নমিনি শুধুই জিম্মাদারের ভূমিকা পালন করেন। হাইকোর্টে এমন রায় আসার পর আপিল হয়েছে। আপিল বিভাগে বিচারাধীন হওয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি।
বর্তমানে ব্যাংক আইন অনুযায়ী নমিনিকে অর্থ বুঝিয়ে দেবে কিন্তু নমিনি যদি তা উত্তরাধিকারীর কাছে না দেন, তাহলে উত্তরাধিকারীকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। নিহত কালামের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

