অকার্যকর ঘোষিত পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করে নতুন ব্যাংক ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ গঠন করা হচ্ছে। নতুন ব্যাংকের জন্য প্রাথমিক সম্মতিপত্র (এলওআই) দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল রবিবার (৯ নভেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ অনুমোদন দেয়। একীভূত হওয়া পাঁচটি ব্যাংক হলো– ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু শর্তসাপেক্ষে এই এলওআই ইস্যু করেছে।
নতুন ব্যাংকের সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক। অন্য বোর্ড সদস্যরা হলেন– অর্থ বিভাগের সচিব মো. খাইরুজ্জামান মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব এম. সাইফুল্লাহ পন্না, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামাল উদ্দিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন ও যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, গত বুধবার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের জন্য এলওআই চেয়ে আবেদন করে। আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে কোম্পানির লাইসেন্স নিতে হবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চূড়ান্ত লাইসেন্স জারি করবে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে।
রবিবার বিকেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নতুন ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা, অর্থছাড়সহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এবং দুই সচিব। নতুন ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ হতে পারে ছয় মাস থেকে এক বছর। এই সময়ের মধ্যে বর্তমান পাঁচটি ব্যাংকের প্রশাসকরা সম্পদ ও দায় যাচাই করবেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের মাধ্যমে নতুন চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেবে এবং ব্যাংকটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত হবে।
এর আগে ৫ নভেম্বর আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত এই পাঁচটি ব্যাংককে অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে তাদের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা পদত্যাগ করেন। প্রতিটি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচজন করে কর্মকর্তা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। গভর্নর বলেন, একীভূত ব্যাংকটি দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হবে। আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ থাকবে। ব্যাংকটি সরকারি মালিকানাধীন হলেও বেসরকারিভাবে পরিচালিত হবে। কর্মীদের বেতন বাজারভিত্তিক হবে এবং আমানতকারীরা মুনাফা পাবেন বাজারের হারে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকের মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার, বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আমানতকারীদের শেয়ার হিসেবে দেওয়া হবে। আলোচ্য পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের নিয়ন্ত্রণে, আর বাকি চারটি ব্যাংক চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ ও খেলাপি ঋণ:
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শওকাতুল আলম দায়িত্ব নিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সালাহ উদ্দিন। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান দিদার। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মো. মোকসুদুজ্জামান। ইউনিয়ন ব্যাংকে দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম। তারা সবাই ব্যাংকগুলোতে গিয়ে দায়িত্ব কার্যকর করছেন।
এই পাঁচ ব্যাংকে মোট ৭৫ লাখ আমানতকারীর জমা আছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশই এখন খেলাপি। সারা দেশে ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ। সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ইউনিয়ন ব্যাংকে, যেখানে ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২.৩০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮.২০ শতাংশ ঋণ খেলাপি। ব্যাংকগুলোতে মোট ১৫ হাজার জনবল কর্মরত।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, বর্তমান জনবল সকলেই থাকবে। শাখা স্থানান্তর সম্ভব হলে ব্যাংক তা যাচাই করবে। কারো চাকরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ভবিষ্যতে একীভূত ব্যাংকের যাত্রা শুরু হলে চাহিদা অনুযায়ী জনবল থাকবে।
গভর্নর আরও বলেন, পাঁচ ব্যাংক একীভূত হলেও সরকারি ব্যাংক হলেও এটি বেসরকারি ব্যাংকের মতো পরিচালিত হবে। ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক চলবে। গ্রাহকসেবায় কোনো বিঘ্ন হবে না। আগের নামেই পেমেন্ট, এলসি খোলা, আমানত ও চেক নিষ্পত্তি এবং রেমিট্যান্স কার্যক্রম চালু থাকবে। চলতি নভেম্বর মাসের শেষের দিকে আমানতকারীরা অর্থ তুলতে পারবে। তবে প্রথমে ২ লাখ টাকার নিচে আমানতের ব্যক্তিরা উত্তোলন করতে পারবেন। ২ লাখ টাকার উপরের আমানতের জন্য শিগগিরই নির্দেশনা জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

