উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় কমেছে। তবুও চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। তবে সব ব্যাংকের আমানত সমানভাবে বাড়েনি। ভাবমূর্তি সংকটে থাকা ও আর্থিকভাবে দুরবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে। বিপরীতে ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের আমানত ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ১৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রাহকের আস্থা ও ব্যাংকের পরিচালনা কৌশলই এ আমানত বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার দীর্ঘদিন এক অঙ্কের মধ্যে আটকে ছিল। এর ফলে আমানতের সুদহারও কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের মাঝামাঝি এই সুদহারের সীমা তুলে দেয়। এরপর ব্যাংকগুলো সুদ বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহে মনোযোগী হয়। তার পরও আমানত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে ভালো ব্যাংকগুলোর আমানত বেশি বেড়েছে। গত আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর কিছু ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক তথ্য সামনে আসে। কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না। অন্যদিকে ভালো ব্যাংকগুলো আরও ভালো করতে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি খাতের মধ্যে আমানতে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি হয়েছে সিটি ব্যাংকে। এরপর রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক, ইউসিবি ও যমুনা ব্যাংক। এই ৯ মাসে আমানত বৃদ্ধির শীর্ষ ১০ ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে পূবালী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংক। “কয়েক বছর ধরে আমরা ব্যাংকটিকে নতুন করে সাজাচ্ছি। আমরা আনন্দিত। সিটি ব্যাংক এখন মানুষের কাছে আস্থা ও জনপ্রিয়তায় চূড়ান্তে উঠেছে,” বলেছেন মাসরুর আরেফিন, এমডি, সিটি ব্যাংক।
প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ তিন ব্যাংক:
গত বছর শেষে সিটি ব্যাংকের আমানত ছিল ৫১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ৯ মাসে আমানত বেড়েছে ১২ হাজার ২০ কোটি টাকা বা ২৩.৪ শতাংশ। আমানত বৃদ্ধিতে এ ব্যাংক ব্যাংক খাতের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। সিটি ব্যাংক এখন দেশের শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি। গত বছর ব্যাংকটির নিট মুনাফা এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকটি ৭২২ কোটি টাকার মুনাফা করেছে।
আমানতের বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, “কয়েক বছর ধরে আমরা ব্যাংকটিকে নতুনভাবে সাজাচ্ছি। আমরা আনন্দিত। সিটি ব্যাংক এখন মানুষের কাছে আস্থা ও জনপ্রিয়তায় শীর্ষে। মানুষ ব্যাংকটিকে বিশ্বাস করে। শীর্ষ নির্বাহীর জন্য এর চেয়ে আনন্দ ও গর্বের আর কিছু হতে পারে না। আমরা সেই সব কাজ করে যাচ্ছি, যা গ্রাহকের বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। এজন্য আমাদের আমানত সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।”
ব্র্যাক ব্যাংকের আমানত গত বছর শেষে ছিল ৭৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। ৯ মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ১৬ হাজার ৬৭ কোটি টাকা বা ২০.৬৮ শতাংশ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ ও বড় শিল্প খাতের উন্নয়নে ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। দেশীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে মুনাফায়ও শীর্ষে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকটি ১ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা গত বছরের ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার তুলনায় বৃদ্ধি।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, “আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু এখন অনন্য উচ্চতায়। দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে আস্থার শীর্ষে রয়েছি আমরা। আমাদের শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এ কারণে আমাদের আমানতও দ্রুত বাড়ছে।”
চলতি বছরের ৯ মাসে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) আমানত সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ৯ মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ১০ হাজার ১২৩ কোটি টাকা বা ১৮.৩৩ শতাংশ। তবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে নিট মুনাফা হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ২২৫ কোটি টাকার তুলনায় কম।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সময়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ইউসিবি এখন নতুন নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এতে গ্রাহকরা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন। নতুন আমানত হিসাব খোলা এবং আমানত বৃদ্ধিও হচ্ছে। তবে সাইফুজ্জামের মেয়াদে দেওয়া ঋণের অনেক খেলাপি হওয়ায় মুনাফা কমেছে।
ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ বলেন, “আমরা ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পথে আছি। ইউসিবিতে গ্রাহকরা শুধু লেনদেন করছেন না, বিশ্বাসের সম্পর্কও গড়ে তুলছেন। ডিজিটাল ব্যাংকিং, দ্রুত সেবা এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপনা আমাদের সাফল্যের মূল কারণ। এতে নতুন আমানত আসছে এবং গ্রাহকেরা ভালো সাড়া দিচ্ছেন।”
আরও যাদের আমানত বেড়েছে:
যমুনা ব্যাংকের আমানত চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেড়েছে ৪ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা, যা ১৪.৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায়, যেখানে গত বছর শেষের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৪১ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ৯ মাসে ৪১৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যেখানে ২০২৪ সালে মুনাফা ছিল ২৭৯ কোটি টাকা।
পূবালী ব্যাংকের আমানত সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। ৯ মাসে আমানত বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা বা ১৪.৭২ শতাংশ। ব্যাংকটি ৯ মাসে ৯০০ কোটি টাকার মুনাফা করেছে, যা গত বছর ৭৬২ কোটি টাকা ছিল। এমডি মোহাম্মদ আলী বলেন, “মানুষের আস্থা আমাদের ব্যাংকে আমানত বাড়িয়েছে। আমরা ব্যাংকের সেবা সম্প্রসারণ করছি। যাতে গ্রাহক যেকোনো স্থান থেকে অনলাইনে সেবা নিতে পারে। এ কারণে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে।”
ইউসিবি ব্যাংক চলতি বছরে ৯ মাসে ১০ হাজার ১২৩ কোটি টাকা বা ১৮.৩৩ শতাংশ আমানত বৃদ্ধি করেছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকায়। প্রথম ৯ মাসে নিট মুনাফা হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর একই সময়ে মুনাফা ছিল ২২৫ কোটি টাকা। এমডি মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ বলেন, “আমরা ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে আছি। গ্রাহকরা শুধু লেনদেন করছেন না, বিশ্বাসের সম্পর্কও গড়ে তুলছেন। ডিজিটাল ব্যাংকিং, দ্রুত সেবা এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপনা আমাদের সাফল্যের মূল। এতে নতুন আমানতও আসছে।”
ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের আমানত ৯ মাসে বেড়ে ৭ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বা ১৪.৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকায়। নিট মুনাফা ২৫৬ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর ৪৭৩ কোটি টাকা ছিল।
ইস্টার্ন ব্যাংকের আমানত ৯ মাসে ৬ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বা ১৩.৬৮ শতাংশ বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের আমানত ৫১ হাজার ৮৯২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। নিট মুনাফা ৫৮৪ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৪ সালে মুনাফা ছিল ৭৫০ কোটি টাকা।
ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত ৯ মাসে ৫ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা বা ১২.১৯ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংকটির আমানত সম্প্রতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ১৮ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা বা ১১.৫৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকায়। ৯ মাসে মুনাফা হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর মুনাফা ছিল ১০৮ কোটি টাকা। এমডি ওমর ফারুক খান বলেন, “গ্রাহকরা আমাদের ব্যাংকে আস্থা রাখছেন। ঋণ আদায়ে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় খেলাপি অর্থ আদায়ে কাজ করা হবে।”
ঢাকা ব্যাংকের আমানত ৯ মাসে বেড়েছে ৩ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা বা ১১.১৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকায়। প্রাইম ব্যাংকের আমানত ৯ মাসে বেড়েছে ৩ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা বা ১১.১১ শতাংশ। প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকের মুনাফা ৬২৯ কোটি টাকা। এমডি হাসান ও. রশীদ বলেন, “ব্যাংকের বৈচিত্র্যপূর্ণ সেবা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেছে। ঢাকার বাইরে ছোট আকারের ঋণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।”
ব্যাংক এশিয়ার আমানত ৯ মাসে বেড়েছে ২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা বা ৭.০৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত ৯ মাসে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা বা ৪.৪০ শতাংশ বেড়েছে, সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায়।

