অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তত তিনজন উপদেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার ১০ শতাংশ থেকে কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, উচ্চ নীতি সুদহার ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহারও বাড়িয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ ও প্রবৃদ্ধি দুই-ই কমছে।
গতকাল সোমবার আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার–সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকে এ প্রস্তাব দেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তাঁদের সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য মনজুর হোসেনও নীতি সুদহার কমানোর পক্ষে মত দেন।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখনই নীতি সুদহার কমানোর সময় নয়। তিনি যুক্তি দেন, সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমায়, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণ নেওয়ার সুযোগ বাড়বে। পাশাপাশি তিনি সরকারি ব্যয়ও কমানোর পরামর্শ দেন।
বৈঠকটি ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে। এতে আরও অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক ও বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, শুরুতে আলোচনার মূল বিষয় ছিল সংশোধিত বাজেট। তবে একপর্যায়ে আলোচনা ঘুরে যায় নীতি সুদহারের দিকে। সেখানে তিন উপদেষ্টা ও পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য সুদহার কমানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, বর্তমান উচ্চ নীতি সুদহার ব্যাংক ঋণের সুদও বাড়িয়েছে, যা বেসরকারি বিনিয়োগের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার বা রেপো রেট। সাধারণত ব্যাংকের ঋণের সুদহার নীতি সুদের চেয়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেশি থাকে। এই হার বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম কার্যকর মুদ্রানীতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমছে:
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সামান্য কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার–সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকে। চলতি বাজেটে এই হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৫ শতাংশে নামানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমান বাজেটে যেখানে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে নতুন করে সেটি ৭ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব এসেছে। তবে এই দুটি সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে ২০২৬ সালের মার্চে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সরকারের লক্ষ্য থেকে কম হতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত মাসে জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক এ হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৫ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও আইএমএফের হিসাব সরকারের চেয়ে বেশি। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশে। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, এটি হবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং এডিবির প্রাক্কলন ৮ শতাংশ।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ২০ হাজার কোটি টাকা কমানো হবে। এতে বাজেটের মোট আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়াবে ৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। এ ছাড়াও, ২০২৬-২৭ অর্থবছরের বাজেট নিয়েও প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে কাউন্সিলে। প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বেশি হতে পারে।

