বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার আরও কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই তহবিলের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারে নামানো হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, “আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির আওতায় ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইডিএফের আকার সর্বোচ্চ ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রাখা হবে। এ সময়ের মধ্যে ইডিএফ বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।” বর্তমানে ইডিএফের পরিমাণ নির্ধারিত সীমার চেয়ে সামান্য বেশি রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, রপ্তানিকারকদের কম খরচে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে ইডিএফ দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে আইএমএফের শর্ত অনুসারে এর আকার আরও কমানো ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকল্প নেই। আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে সরকারও বৃহত্তর আর্থিক ও কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন করছে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্রমাগত ডলার সংকট এবং রিজার্ভ কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে ইডিএফের আকার কমিয়ে এনেছে।
করোনা মহামারির সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলার জন্য ইডিএফের আকার ৭ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট গভীর হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিলের আকার ধীরে ধীরে কমাতে শুরু করে। কারণ কম আকারের ইডিএফ থেকে অর্থ ছাড় হলে কাগজে-কলমে রিজার্ভ বাড়তে সাহায্য করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “আইএমএফের চুক্তি মোতাবেক আমরা ইডিএফ ফান্ড ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা করেছি। যদিও ফান্ড বড় থাকলে রপ্তানিকারকরা বেশি ঋণ নিতে পারতেন।” রপ্তানিকারকরা বলছেন, তহবিল কমানোর কারণে এখন ইডিএফ থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকের জন্য অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে, আবার অনেকে আবেদন করাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “ইডিএফের আকার বড় থাকলে ফান্ড সব সময় উপলব্ধ থাকত। তখন সহজেই ঋণ নেওয়া যেত। এখন আকার ছোট হওয়ার কারণে ঋণ পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ফান্ড এলে তখনই ঋণ পাওয়া সম্ভব। নানা ঝামেলার কারণে আমি নিজেও এখন ইডিএফ থেকে ঋণ নিই না।”
অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন:
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বছরের পর বছর রপ্তানিকারকদের সহায়তা করলেও ইডিএফ দেশের রপ্তানি ভিত্তি বহুমুখীকরণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ইডিএফ ফান্ড রপ্তানিকারকরা মূলত ট্রেডিংয়ের জন্য ব্যবহার করেন। নিঃসন্দেহে এটা অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু রিজার্ভ সংকট ও আইএমএফের স্বচ্ছ হিসাবনিকাশের দাবি শুরু হলে ফান্ডে বড় ধরনের কাটছাঁট শুরু হয়।”
তিনি আরও বলেন, “ফান্ডটি ভালো কাজ করছিল। তবে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণে এটি কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার জন্য ফান্ড ব্যবহারের নতুন চেষ্টা করা জরুরি। রিজার্ভের কারণে হয়তো ইডিএফের আকার কমানো হয়েছে, তবে ভবিষ্যতে ফান্ড আরও বাড়ানো দরকার। ৭ বিলিয়ন ডলার না হলেও এর কাছাকাছি আকারে নেওয়ার যৌক্তিকতা আছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা স্বীকার করেন, “ইডিএফের অনেক অপব্যবহার হয়েছে। এ কারণে আইএমএফ ফান্ডের আকার কমানোর তাগিদ দিয়েছে। অন্যথায় ব্যাংক আলোচনা করত যে রপ্তানিকারকরা উপকৃত হচ্ছেন। এ ফান্ডের অপব্যবহার কে করেছে, তা সবাই জানে।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “ফান্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা। কিন্তু বাস্তবে বৈচিত্র্য দেখা যায়নি। গার্মেন্টস খাতের ওপর নির্ভরশীলতা এখনও বজায় রয়েছে।”
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, “এত বছর ধরে এত বড় আর্থিক সহায়তা থাকা সত্ত্বেও বৈচিত্র্যকরণে কোনো প্রভাব পড়েনি। এটা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ইডিএফ থেকে যে ফান্ডিং দেওয়া হয়েছে, সেটার অডিট করা দরকার। কারণ কম সুদে ঋণ দেওয়ার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ফলাফল আসেনি।” তিনি উল্লেখ করেন, “চামড়া, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ বা হালকা প্রকৌশল খাতগুলোকেও প্রত্যাশামাফিক উৎসাহিত করতে পারেনি ইডিএফ। পোশাক খাতের ভেতরেও উচ্চমূল্যের [হাই ভ্যালু] পণ্য তৈরি করার উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু মূলত ৪-৫টি সাধারণ আইটেমই তৈরি হচ্ছে।”
ইডিএফের অপব্যবহার:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, কিছু রপ্তানিকারক ইডিএফ ঋণের অপব্যবহার করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু ঋণগ্রহীতা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে রিজার্ভ থেকে দেওয়া ঋণ বড় হয়ে ‘ফোর্সড লোনে’ পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, “ঋণ দেওয়ার মূল লক্ষ্য ছিল রপ্তানিকে উৎসাহিত করা। ন্যূনতম সুদে ঋণ পেলে রপ্তানিকারকরা দেশে আরও বেশি আয় আনেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা পেমেন্ট না করায় রপ্তানি আয় আসে না। এতে ফোর্সড লোনের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ইডিএফ ঋণের বিপরীতে তৈরি হওয়া ফোর্সড লোন ২০২১ সালে ৪১০ শতাংশ বেড়ে ৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, “ঋণগ্রহীতা গ্রাহক যদি ম্যাচিউরিটির সময় এলসির পেমেন্ট করতে ব্যর্থ হন, তবুও দেশীয় ব্যাংককে বিদেশি ব্যাংকের কাছে দায় নিষ্পত্তি করতে হয়। তখন গ্রাহকের অনুকূলে ফোর্সড লোন তৈরি হয়। আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই এলসি নিষ্পত্তিতে দেরি ঘটতে পারে।”

