২০২৫ সালের চলতি বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভোক্তা ঋণে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি দেখেছে। বিশেষ করে ফ্ল্যাট ও গাড়ি কেনার ঋণের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সামগ্রিক অর্থনীতির মন্থরতার মধ্যেও ব্যক্তিগত ও ভোক্তা সামগ্রীর ঋণ বৃদ্ধি স্পষ্ট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের জুনে ভোক্তা ঋণ বছরওয়ারি ২৬ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে মোট ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ শতাংশ হয়েছে। অটো লোন বা গাড়ি কেনার ঋণ সর্বোচ্চ ৫৮.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আবাসন বা ফ্ল্যাট ঋণে বৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ।
ব্যক্তিগত ঋণ এবং ভোক্তা সামগ্রী—যেমন টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও আসবাব—এসব খাতেও ঋণ সুবিধা ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০২৫ সালের জুন শেষে দেশে মোট ভোক্তা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংক ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। এক বছর আগে এই হার ছিল ৮.৫৭ শতাংশ। বর্তমানে ভোক্তা ঋণে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১.৫ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) সর্বোচ্চ ১২.৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। করপোরেট ঋণের চাহিদা দুর্বল থাকার কারণে ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নিকট ভবিষ্যতে ভোক্তা ঋণের সুদের হার আরও কমতে পারে।
ভোক্তা ঋণে মনোযোগ বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো:
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্প্রতি রিটেইল বা খুচরা ঋণের উল্লম্ফন মূলত ব্যাংকগুলোর কৌশলগত স্থানান্তরকে প্রতিফলিত করছে। তারা প্রবৃদ্ধিনির্ভর করপোরেট ঋণ থেকে সরে এসে ব্যয়কেন্দ্রিক ভোক্তা ঋণে জোর দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির থাকায় এবং খুচরা ঋণে খেলাপির হার তুলনামূলকভাবে কম থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যক্তিগত ঋণগ্রহীতাদের দিকে ঝুঁকছে। “রিটেইল লোনের পরিমাণ কম হয়, আবার এটি বৈচিত্র্যপূর্ণ, ফলে বড় করপোরেট ঋণের মতো ব্যাংকের জন্য কেন্দ্রীভূত ঝুঁকি তৈরি হয় না,” যোগ করেন তিনি।
বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ব্যক্তিগত ঋণ, ৬০ লাখ টাকা অটো লোন এবং ২ কোটি টাকা পর্যন্ত হোম লোন নেওয়া যায়। ডাচ-বাংলা ব্যাংক, যাদের হাউজিং ফাইন্যান্সে বাজারের সবচেয়ে বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে, ২০২৫ সালের নভেম্বরে এককভাবে ১০০ কোটি টাকার হোম লোন বিতরণ করেছে। এটি ব্যাংকের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ বিতরণ। ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, ঋণের এই প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রয়েছে এবং ফ্ল্যাট কেনার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোক্তা ঋণের মোট ৭ শতাংশের বেশি বাজার অংশীদারিত্ব থাকা সিটি ব্যাংক ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
সিটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব রিটেইল ব্যাংকিং মো. আরুপ হায়দার বলেন, “করপোরেট খাতে ঋণচাহিদা কম থাকায় এ বছর ব্যাংকগুলো ভোক্তা ঋণেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের মাসিক ভোক্তা ঋণ বিতরণ এক বছরে ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে, যা এক বছর আগের ২৫০–২৬০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।”
তিনি আরও জানান, ভোক্তা ঋণে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি এসেছে অটো লোন বা গাড়ি কেনার ঋণ থেকে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ সীমা ৪০ লাখ টাকা থেকে ৬০ লাখ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত। এছাড়া বিকাশ-এর সঙ্গে সিটি ব্যাংকের ন্যানো লোন পার্টনারশিপও সার্বিক ভোক্তা ঋণ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
গাড়ির ঋণে জোরালো উত্থান:
আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের কনজিউমার ডিভিশন প্রধান মাহজেবিন বিনতে রহমান জানিয়েছেন, সেকেন্ড হ্যান্ড বা ব্যবহৃত গাড়ি কেনার জন্য ঋণ অনুমোদনের ফলে অটো লোনে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। আগে এই ধরনের ঋণ অনুমোদিত ছিল না। এ পরিবর্তনের ফলে অটো লোনের চাহিদাও বেড়েছে।
তিনি জানান, অস্থির সময়ের মধ্যে উচ্চমূল্যের গাড়ির বিক্রি কিছুটা কমলেও ২০২৫ সালে আইডিএলসির মোট অটো লোনের পোর্টফোলিও ১০ শতাংশ বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা ঋণ নিয়ে উচ্চমূল্য সামাল দিতে বাধ্য হয়েছেন।
একটু কম দামের গাড়ির বিক্রিও বেড়েছে, যা মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের মধ্যে চাহিদা বাড়িয়েছে। বারভিডার সভাপতি আবদুল হক বলেন, “মধ্যবিত্তের কাছে গাড়ি এখন বিলাসদ্রব্য নয়, বরং প্রয়োজনীয়তার জায়গা দখল করছে। ৪০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকার মধ্যে থাকা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রি এ বছর উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যাংক ঋণ পাওয়ার সুবিধা প্রধান সহায়ক ছিল। বেশ কয়েকটি ব্যাংকও তাদের অতিরিক্ত তারল্য গাড়ি কেনার ঋণে বিনিয়োগ করছে।” বারভিডারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে গাড়ির বাজার কমপক্ষে ১০ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। বছরের শেষ দিকে আরও প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা, ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয় জোরালো:
অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও প্রবাসী আয়ের রেকর্ড প্রবাহ ও শক্তিশালী রপ্তানি আয়ের ভিত্তিতে ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয় ৫ শতাংশেরও বেশি বেড়ে দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয়ের বৃদ্ধি সামান্য কমে ৫.২ শতাংশে নেমে এসেছে। তবুও ভোগ ব্যয় স্থিতিশীল রয়েছে এবং সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে রপ্তানি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ১৫.৩ শতাংশ বেড়ে যায়। এটি টানা দুই বছর আমদানি সংকোচনের পর প্রথমবারের মতো ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। টাকার অবমূল্যায়ন, প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোর টেকসই চাহিদা এবং প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে তৈরি পোশাকের অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তর রপ্তানি বৃদ্ধিকে সমর্থন দিয়েছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদহার, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া এবং জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগের কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ দুর্বলই রয়ে গেছে।
বেসরকারি বিনিয়োগের এই মন্থরতা প্রতিফলিত হয়েছে ২০২৫ সালের জুনে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের বৃদ্ধির মাত্র ৬.৫ শতাংশে নেমে আসায়—যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী পণ্য ও যন্ত্রাংশের আমদানি ১০.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সরকারি বিনিয়োগও কমেছে; উন্নয়ন ব্যয় ২৫.৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে, যা সরকারের সতর্ক অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৮ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। মূলত মূল্যস্ফীতি কমে গেলে ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয় আরও বাড়বে। তবে বিনিয়োগ খাত সামান্য উন্নতি পেলেও সামগ্রিকভাবে দুর্বলই থাকবে। নির্বাচনী অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা বিনিয়োগকে চাপে রাখবে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক শুল্ক অনিশ্চয়তার মাঝেও শক্তিশালী থাকবে।

