বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত প্রক্রিয়াধীন পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের তীব্র তারল্যসংকট মোকাবিলায় বিশেষ ছাড়মূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নির্দেশে এসব ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে প্রি-ফাইন্যান্স, রিফাইন্যান্স বা অন্যান্য বিশেষ অর্থায়ন তহবিলের আদায়কৃত অর্থ কেটে রাখার নিয়ম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। সিদ্ধান্তের লক্ষ্য ব্যাংকগুলোর নগদ প্রবাহ সচল রাখা এবং একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চালানো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রি-ফাইন্যান্স, রিফাইন্যান্স ও বিশেষ আবর্তিত ফান্ডের মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংক মোট প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করেছিল। এর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ছিল বিশেষ অর্থায়ন প্রকল্পের জন্য। এখন এসব ঋণের অর্থ আদায় শুরু হয়েছে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আদায়কৃত অর্থের একটি অংশ ফেরত দিতে হয়। তবে ব্যাংকগুলোর নগদ ঘাটতি ও চলতি হিসাবের চাপ বিবেচনা করে এই কর্তন আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলো হলো এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। একীভূত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ নভেম্বর তাদের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে এবং ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এক বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, “এই ব্যাংকগুলোর অবস্থা এতটাই নাজুক যে রিফাইন্যান্স বা প্রি-ফাইন্যান্সের টাকা কেটে রাখলে তারা দৈনন্দিন লেনদেনও পরিচালনা করতে পারবে না। তাই প্রশাসকদের সুপারিশে গভর্নর এই কর্তন সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছেন।”
সূত্র জানায়, এসব ব্যাংকের সম্মিলিত ঋণ পোর্টফোলিও প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে আমানত আছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ। ব্যাংকভিত্তিক খেলাপির হার হলো: ইউনিয়ন ব্যাংক ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ৯৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ৬২.৩০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংক ৪৮.২০ শতাংশ। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য ঘাটতি সাময়িকভাবে কিছুটা প্রশমিত হবে। এখন প্রশাসকদের দায়িত্ব একীভূত ব্যাংকের আর্থিক কাঠামো টেকসই করা এবং সম্পদ ও দায়ের সঠিক হিসাব তৈরি করা।”
সরকার নতুন সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রাথমিক মূলধন অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরাসরি সরকারি অর্থায়নে দেওয়া হবে, বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আমানতকারীদের সমপরিমাণ শেয়ারের মাধ্যমে পূরণ হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যাংক চালু হলে এটি দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। গভর্নর সরাসরি একীভূতকরণের সব ধাপ নজরদারি করছেন।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংস্কার কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “এই পাঁচ ব্যাংকের অনেক আমানতকারী এখনো জমা অর্থ তুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, প্রি-ফাইন্যান্স ও রিফাইন্যান্স তহবিলের আদায়কৃত টাকা কর্তন বন্ধ করলে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ প্রবাহ বাড়বে। এতে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া সহজ হবে এবং ধীরে ধীরে আস্থা ফিরবে। একই সঙ্গে প্রশাসকরা একীভূতকরণ-সংক্রান্ত আর্থিক বিশ্লেষণ ও পুনর্গঠন কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবেন।”

