দীর্ঘ ২৫ বছর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা গোপালগঞ্জের কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর তিনি নিজে পদত্যাগ করেন। তবে তিনিসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট এখনও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, তারা আবার ব্যাংকটি দখলের চেষ্টা করছে। তাদের এক পক্ষ ইতিমধ্যেই নিজেদের পছন্দের একজনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় ব্যাংকটিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, ১৬ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে ছয়জন সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়ে ভাইস-চেয়ারম্যান একেএম আব্দুল আলিমকে চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেছেন। একই চিঠিতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমানকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে। তবে এটি আইনসিদ্ধ নয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ৬ নভেম্বর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে এমডিকে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কে হবেন, তা বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ঠিক হয়। এমডিকে ছুটিতে পাঠানোর বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। তা না করে কেউ নিজ থেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারবে না।”
জানা গেছে, নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা আব্দুল আলিম সাবেক চেয়ারম্যান কাজী আকরামের ছেলে কাজী খুররম আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন আরও কয়েকজন পরিচালক, যার মধ্যে আছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহেদুল হক। তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে জালিয়াতির মাধ্যমে সৎ ভাইদের জমিতে নির্মিত একটি ভবন ব্যাংকের কাছে উচ্চ মূল্যে ভাড়া দেওয়া হয়। এই ঘটনায় জাহেদুল হক পরিচালক পদ হারাতে পারেন।
তালিকায় আরও রয়েছেন পরিচালক কামাল মোস্তফা চৌধুরী, অশোক কুমার সাহা, অসিত কুমার সাহা এবং স্বতন্ত্র পরিচালক গোলাম হাফিজ আহমেদ। গোলাম হাফিজ ছিলেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। এই প্রভাবের কারণে তিনি ২০১৪ সালে জোরপূর্বক এনসিসি ব্যাংকের এমডি হন এবং ২০১৮ সালে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তবে নানা অভিযোগে তিনি পুরো মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের সময়ে ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও, সাবেক চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ ও তার ছেলে কাজী খুররম আহমদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। দুদকের আবেদনে ১৪ মে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন। অভিযোগ, ব্যাংকে অগণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন, ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৪১৯তম পর্ষদ সভায় ৫৬টি এজেন্ডা ছিল। চেয়ারম্যান নির্বাচন বা এমডিকে ছুটিতে পাঠানোর বিষয় ছিল না। সভা শেষে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমসহ ছয়জন পরিচালক নিজেদের মধ্যে দুটি নতুন এজেন্ডা তৈরি করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রেজুলেশন প্রস্তুত করেন। পরে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। আবদুল আজিজ বলেন, “এটি করপোরেট গভর্ন্যান্স বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমার ছেলে আব্দুল আলিম অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে, যা ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।”
আবদুল আজিজের চিঠিতে উল্লেখ, বর্তমান এমডি একজন সৎ, মেধাবী ও পরিশ্রমী ব্যাংকার। তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই। বরং তিনি অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাই কিছু পরিচালক হয়তো বেআইনিভাবে তাকে টার্গেট করছে। চিঠির সত্যতা বিষয়ে তিনি বলেন, ভুয়া এজেন্ডা তৈরি করে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে এবং এমডিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ১৬ জন পরিচালক থাকা সত্ত্বেও ছয়জনকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলা যায় কি না, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। সাবেক চেয়ারম্যান বা তার ছেলের ভূমিকা নিয়ে তিনি নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না, তবে মনে হয় কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র ছিল।
ব্যাংকের এমডি মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় ৫৯ ও ৬০ নম্বর এজেন্ডা ভিত্তিতে তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, অথচ সেই দিন সর্বশেষ এজেন্ডা ছিল ৫৬। বাংলাদেশ ব্যাংকে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম ফোনে যোগাযোগ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বিস্তারিত বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি।

