নিত্যপণ্যের বাজারে যে চাপ, তার সঙ্গে সরকারি মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানের মিল খুব কমই মেলে। বিশেষত বাজারে গিয়ে চাল, ডাল, তেল বা সবজি কিনতে গেলেই মানুষ বাস্তব মূল্যস্ফীতির স্বাদ টের পায়। অর্থাৎ সরকারি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। এ বৈষম্য নতুন নয়।
পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের জীবনযাপনের প্রকৃত ব্যয়ের চিত্র অনেক সময় সেখানে প্রতিফলিত হয় না। বাস্তবতা হলো, বছরের পর বছর দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সরকারি মূল্যস্ফীতির হার ও মানুষের প্রতিদিনের ভোগান্তির এই পার্থক্য দেখায়—মূল্যস্ফীতি পরিমাপের পদ্ধতিতেই রয়েছে কাঠামোগত ঘাটতি। নীতিনির্ধারকরা সাধারণত বছরভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হারে নজর দেন, যা এখন ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যে মূল্যস্তর বেড়েছে, সেটি বিশ্লেষণ করা হয় না। অথচ দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি বোঝা জরুরি, কারণ এটি পরিবার, ব্যবসা এবং সামগ্রিক অর্থনীতি–সবকিছুতেই সরাসরি প্রভাব ফেলে।
গত দুই দশকে মূল্যস্তর কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা বুঝতে আমরা ২০০০-০১ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতির তথ্য পর্যালোচনা করেছি। এই বিশ্লেষণে গত ২৫ বছরের সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা উঠে এসেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) ভিত্তি বছর বদলেছে তিনবার—১৯৯৫-৯৬, ২০০৫-০৬ এবং সর্বশেষ ২০২১-২২। মূল্যস্তরের সঠিক তুলনা নিশ্চিত করতে আমরা ২০২১-২২ অর্থবছরকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছি। এতে বিভিন্ন সময়ের মূল্যপরিবর্তনের বাস্তব চিত্র পরিষ্কার হয়েছে। এই বিশ্লেষণ দেখায়—গত ২৫ বছরে ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি কীভাবে সাধারণ পরিবারের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়।
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০-০১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মূল্যস্তর বা সাধারণ সিপিআই বেড়েছে ৩৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে জীবনযাত্রার মোট ব্যয় সাড়ে চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। সহজ হিসাব—২০০০-০১ সালে কোনো পণ্য বা পরিষেবা কিনতে যেখানে ১০০ টাকা লাগত, এখন একই জিনিসের জন্য ৪৫৩ টাকার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এখানে মূল দাম যোগ হয়েছে ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতির সঙ্গে। সূত্রটি হলো: মূল দাম + (ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতি × মূল দাম)।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যের দাম। এ বৃদ্ধির হার ৪০১ দশমিক ৫ শতাংশ। নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ার মূল কারণও এটি। তাদের আয়ের বড় অংশই যায় খাদ্য খাতে। ভাত, ডাল, সবজি, তেল—এসব সাধারণ খাদ্যপণ্য ২০০০-০১ সালে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী ছিল। এখন একই পণ্য কিনতে আয়ের বড় অংশ খরচ করতে হচ্ছে। ফলে আয় বাড়লেও পরিবারগুলো টানাপড়েন থেকে বের হতে পারছে না। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে—২৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর ভেতরে কিছু পণ্যের দাম আরও দ্রুত বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে আসবাবপত্র ও গৃহসজ্জা সামগ্রীর দাম বেড়েছে ৩৬৫ দশমিক ২ শতাংশ। যে আসবাব ২০০০-০১ সালে ১ হাজার টাকায় কেনা যেত, এখন তা কিনতে ৪ হাজার ৬৩২ টাকার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।
পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৩৯৬ দশমিক ১ শতাংশ। পোশাক ও জুতার দাম বেড়েছে ৩২৫ দশমিক ১ শতাংশ। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বেড়েছে ২৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্যক্তিগত খরচ থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৩৬৯ দশমিক ১ শতাংশ। কেবল বিনোদন এবং শিক্ষা খাতে তুলনামূলক ব্যয় কম বেড়েছে—১৭০ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও এটিও প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধির কাছাকাছি। ১৩ বছরের মতো তুলনামূলক স্বল্প সময়ের হিসাব বুঝতে সহজ। তাই ২০১০-১১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতির মধ্যমেয়াদি প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট দেখা যায়—এই সময়ে সাধারণ পণ্যের দাম বেড়েছে ১৩৮ দশমিক ২ শতাংশ। খাদ্যের দাম বেড়েছে আরও বেশি, ১৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে কোনো পণ্যের দাম যদি ১০০ টাকা হতো, এখন সেটি ২৩৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর ১ হাজার টাকার খাদ্যপণ্য কিনতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ টাকারও বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে ১৩১ দশমিক ৮ শতাংশ। এ তথ্য পরিষ্কার করে যে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ পারিবারিক বাজেটের প্রতিটি খাতে প্রভাব ফেলেছে।
মহামারী শুরুর পর ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে মাত্র তিন বছরে সাধারণ মূল্য বেড়েছে ২৬ শতাংশ। বছরে গড়ে প্রায় ৯ শতাংশ হারে দাম বেড়েছে। এ সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মহামারীর শুরুতে যে খাদ্যপণ্যের দাম ছিল ১ হাজার টাকা, এখন সেটি ১ হাজার ২৬৭ টাকা। মধ্যমেয়াদি এবং মহামারী-পরবর্তী তথ্য বলছে—মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিক কোনো সমস্যা নয়। বহু বছর ধরেই মূল্যস্তর ঊর্ধ্বমুখী, এবং এর চাপ সরাসরি পড়ছে মানুষের জীবনযাত্রায়।
পরিসংখ্যান প্রণয়নকারী সংস্থাগুলো প্রতি বছর তথ্য হালনাগাদ করে। এটি প্রয়োজনীয়ও বটে। কারণ সময়ের সঙ্গে মানুষের ভোগব্যবহার বদলায়। যেমন—একসময় মানুষ ক্যাসেটের ফিতা কিনত, এখন তা নেই। আবার আজকের দিনে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, রাইডশেয়ার—এসব খাতে খরচ বাড়ছে, যা ২০০১-০২ সালে ছিল না। একই সঙ্গে বহু পণ্যের গুণগত মানও সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে। মোবাইল ফোনের দ্রুত মডেল পরিবর্তনই এর বড় উদাহরণ। এসব পরিবর্তনকে পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করতে নিয়মিত হালনাগাদ করা জরুরি।
তবে ভিত্তি বছর নিয়মিত বদলানোয় একটি সমস্যা তৈরি হয়—ক্রমসঞ্চিত বা দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র আড়ালে চলে যায়। যখন মূল্যস্ফীতি বেশি থাকা কোনো সময়কে বেজলাইন ধরে ১০০ নির্ধারণ করা হয়, তখন পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি তুলনামূলক কম দেখায়। যেমন ওই বেজলাইন ধরার পর ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কম মনে হতে পারে, কিন্তু এটি যদি ২০০১-০২ সালের তুলনায় ধরা হয়, তাহলে তা ২৭১ শতাংশ বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। এ আলোচনার উদ্দেশ্য কারও ওপর দায় চাপানো নয়। লক্ষ্য হলো—অর্থনৈতিক তথ্য যেন পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ পায়, যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃত মূল্যস্ফীতির ধারণা পেতে পারে এবং নীতিনির্ধারণেও তা কাজে লাগে।
এ সংখ্যাগুলো জীবনযাত্রার মানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নির্দেশ করে। ২০০০-০১ অর্থবছরে যে মধ্যবিত্ত পরিবার মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় দিয়ে জীবন নির্বাহ করত, একই মানের জীবনযাত্রার জন্য বর্তমানে প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা প্রয়োজন। এই চিত্র ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকারি মজুরি তথ্য দেখায়—২০১০-১১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১৩৮ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে মজুরি বেড়েছে মাত্র ১১১ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ, ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এ ব্যবধান পুরো দেশে দেখা যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) জানিয়েছে, তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ১ দশমিক ৬৫ কোটি থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৩৬ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ কর্মরত থাকায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা সুরক্ষিত নয়।
ক্রয়ক্ষমতার ধারাবাহিক হ্রাসের অর্থনৈতিক প্রভাবও বড়। সাধারণ ধারণা মূল্যবৃদ্ধি বিনিয়োগ এবং নতুন ব্যবসা আকৃষ্ট করে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতি এর বিপরীত প্রভাব ফেলেছে। ভবিষ্যতের ব্যয় অনিশ্চিত হওয়ায়, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, উৎপাদনের অতিরিক্ত খরচের কারণে লাভের মার্জিন কমছে। ফলশ্রুতিতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। বাজারে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সর্বোপরি, মূল্যস্ফীতির হালনাগাদকৃত তথ্যের প্রয়োজন অপরিসীম। তেমনই ক্রমসঞ্চিত মূল্যস্ফীতিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত হালনাগাদ করা ও ওজনসহ চেইন-ওয়েটেড সিপিআই পদ্ধতি গ্রহণ করা। এই পদ্ধতি পরিবর্তিত ব্যয়ধারার প্রতিফলন ঘটায় এবং অতীতের সঙ্গে তুলনাযোগ্যতাও ধরে রাখে। ফলে পরিবারের বাস্তবে অনুভূত ক্রমবর্ধমান মূল্যচাপ আড়ালে থাকে না।
সৈয়দ আবুল বাশার: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক। সূত্র: বনিক বার্তা

