গত দেড় দশকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের শাসনামলের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি হলো জনতা ব্যাংক পিএলসি। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি এখন খেলাপি।
নগদ অর্থের তীব্র সংকটে থাকা ব্যাংকটি কেবল গত বছরই ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি নিট লোকসান গুনেছে। ঋণ দেয়ার মতো অবস্থার অভাবে ব্যাংকের ১৪ হাজারের বেশি কর্মীর কাজ নেই। কেউ কেউ কেবল দৈনন্দিন লেনদেন ও আমানত সংগ্রহের কাজ করছেন। বাকিরা সময়ের অংশ অলসভাবে কাটাচ্ছেন। ২০০৯ সালের পর লুটপাটে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বেসিক ব্যাংকও একই পথে। গত এক দশকে এ ব্যাংক ৫ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা নিট লোকসান গুনেছে। প্রায় ৭০ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে ধুঁকতে থাকা এ ব্যাংকে দুই হাজারের বেশি কর্মী রয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এদের বড় অংশের কার্যক্রম নেই। সময় যত যাচ্ছে, বেসিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি তত গভীর সংকটে যাচ্ছে।
দেশে বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন ৯টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। বিশেষায়িত তিন ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এর বাইরে তফসিল-বহির্ভূত ব্যাংক রয়েছে আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকে বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত রয়েছেন। বিপুল খেলাপি ঋণ, মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতি, তারল্য সংকট, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও অন্যান্য সমস্যা মিলিয়ে প্রায় সব ব্যাংকই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেক কর্মী এখন অলস সময় পার করছেন। কাজের চাপ না থাকায় কর্মীদের মধ্যে দলাদলিও বেড়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ছিল সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও পেনশন পরিশোধ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, সরকারি চালানের অর্থ আদায়, সরকারিভাবে আনা পণ্যের আমদানির এলসি খোলা এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ বিভিন্ন সেবার মাসুল আদায়। কিন্তু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে এখন এসব কাজের বড় অংশ অনলাইনে করা হয়। সরকারি চালান আদায় ও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো যুক্ত হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতার কারণে তেমন কোনো এলসি খোলার প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব ও কাজ এখন সীমিত। ঋণ বিতরণও প্রায় বন্ধ থাকায় ব্যাংক কর্মীদের বড় অংশের হাতে কাজ নেই। দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, কিছু কর্মী কেবল ‘বসে বসে বেতন নিচ্ছেন’।
এ অবস্থায় সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী মনে করেন, সরকারের মালিকানায় এত ব্যাংক রাখার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, ‘চালান আদায়, ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা, বেতন ও পেনশন পরিশোধসহ সরকারি কাজ এখন অনলাইনে করা যায়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও চালান আদায়ে যুক্ত। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরতা অনেক কমে গেছে। আমি মনে করি, সোনালীসহ দুই-তিনটি ব্যাংকই যথেষ্ট। কৃষি ব্যাংক কেবল কৃষকদের ঋণ বিতরণে কাজ করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৭ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এগুলোকে ধীরে ধীরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে সরকারের মালিকানা কমানো। কিন্তু রূপালী ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে যেতে পারেনি। পুঁজিবাজারে যাওয়ার পরও রূপালী ব্যাংকের অবস্থায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। দেশের ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে হলে সব ক্ষেত্রেই কার্যকর সংস্কার প্রয়োজন। গত এক বছরে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখিনি।’
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বেসরকারি ব্যাংক সংস্কারে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেন। অন্তত ১৪টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংকে রূপান্তরের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তবে সরকারি ব্যাংক সংস্কারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও এমডি পদে পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় এসব ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি বা লুটপাট খতিয়ে দেখার জন্য কোনো বিশেষ নিরীক্ষা হয়নি।
সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। দেড় দশক ধরে এসব নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অনেক আমলাও এসব অনিয়মে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু গত এক বছরে তাদের দায় ও সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক—সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী—এর খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বিতরণকৃত ঋণের ৪৮.১০ শতাংশই এখন খেলাপি। এছাড়া, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেও ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছে।
সোনালী ব্যাংক ছাড়া বাকি তিন ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ৬৮ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে জনতা ব্যাংকের নিট লোকসান ২ হাজার ৭২ কোটি টাকা হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের ক্ষত আরও গভীর। এর ঋণের ৮ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৬৯.২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) বিতরণকৃত ঋণের ৪২.১০ শতাংশও খেলাপি হিসাবের মধ্যে রয়েছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতোই নাজুক অবস্থায় রয়েছে বিশেষায়িত তিন ব্যাংক। এর মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি ব্যাংক বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে। গত ছয় অর্থবছরে ব্যাংকটি প্রায় ১৯ হাজার ১০০ কোটি টাকার নিট ক্ষতি করেছে। মূলধন ঘাটতি ২৯ হাজার ২০৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ঋণখেলাপিও উদ্বেগজনক। চলতি বছরের জুন শেষে মোট ঋণের ৪৯.৪৪ শতাংশ, অর্থাৎ ১৭ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে ধরা হয়েছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিস্থিতিও প্রায় একই। এর বিতরণকৃত ঋণের ২২ শতাংশের বেশি খেলাপি। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের নিয়মিত কাজ কমে যাওয়াও ঋণের স্থিতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক—সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী—এর বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। পরবর্তী ছয় মাসে তা কমে ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা এবং জুনে চার ব্যাংকের ঋণ স্থিতি নেমে এসেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায়। বেসিক, বিডিবিএল, বিকেবি, রাকাব ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকেরও ঋণ স্থিতি সংকুচিত হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘নিজেকে সরকারি কর্মচারী বলে পরিচয় দেয়া ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মীদের এখন তেমন কোনো কাজ নেই। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে ঋণের চাহিদা কম। চাহিদা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য নেই। শাখা পর্যায়ে ‘ক্যাশ কাউন্টারে’ কাজ করা কিছু কর্মীর দায়িত্ব। বাকিরা ব্যাংকে এসে সময় কাটাচ্ছেন।’ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংক হলো সোনালী। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকের আমানত স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা (আন্তঃব্যাংক আমানত ছাড়া)। এত বিপুল আমানত থাকা সত্ত্বেও জুন পর্যন্ত ঋণ স্থিতি মাত্র ৮৯ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা ছিল (স্টাফ ঋণ বাদে)। গত বছরের ডিসেম্বরে ঋণ স্থিতি ছিল ৯৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ স্থিতি কমেছে ৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এ কারণে সোনালী ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) এখন মাত্র ৫৭ শতাংশ।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকটি ৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। তবে এর বেশির ভাগ মুনাফা এসেছে সরকারি কোষাগার থেকে। উচ্চ সুদের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে ছয় মাসে ৪ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা আয় হয়েছে। যেখানে সুদ খাত থেকে আয় হয়েছে মাত্র ৫৭৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলক কম। জুন শেষে খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২০.১৩ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. শওকত আলী খান বলেন, ‘ঋণ স্থিতির দিকে তাকালে মনে হবে আমরা ঋণ দিচ্ছি না। কিন্তু বাস্তবে আমরা এসএমই খাতে অনেক ঋণ বিতরণ করেছি। ব্যাংকের অন্যান্য আর্থিক সূচকও উন্নতি করছে।’ গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে জনতা ব্যাংক। বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা, এননটেক্স, ক্রিসেন্টসহ কয়েকটি বড় গ্রুপ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে, যা এখন খেলাপির খাতায় রয়েছে। জুন শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের ৭৫.৯১ শতাংশ ঋণ এখন খেলাপি। সঞ্চিতি ঘাটতি ৪৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটি ২ হাজার ৭২ কোটি টাকার লোকসান করেছে। অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংক ১১-১৩ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, উচ্চ সুদের এই আমানত দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংককে আরও কঠিন অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের এমডি মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমি একটি বিধ্বস্ত ব্যাংক পেয়েছি। ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। নেতিবাচক ভাবমূর্তির মাঝেও ১৬ হাজার কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। বিপুল এলসি দায় সমন্বয় করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা তিন বছরের বেশি একই শাখা বা বিভাগে থাকতে পারবে না। কিন্তু জনতা ব্যাংকে অনেক কর্মকর্তা সাত-আট বছর বসে ছিলেন। তাদের বদলি করেছি। তবে আর্থিক পরিস্থিতির কারণে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’ জনতার মতোই আর্থিকভাবে সংকটে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ৭২ হাজার কোটি টাকায় আটকে আছে। এর মধ্যে ৩২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা খেলাপির খাতায়, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪১ শতাংশ। ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতি ১১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের এমডি ছিলেন। ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের সংকট কল্পনারও বাইরে। ২০১০ সালের পর ব্যাংককে প্রায় শেষ করে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ডেবিট হয়েছে, কিন্তু গ্রাহকের হিসাব থেকে তা নেওয়া হয়নি। ৭৩৫ দিন ধরে এ অর্থ ওভারডিউ ছিল। আমার দীর্ঘ ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে এত বড় জালিয়াতি দেখিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত দেড় দশকে অগ্রণী ব্যাংক থেকে মূলত আওয়ামী ঘরানার লোকরা ঋণ পেয়েছে। জালিয়াতির আশ্রয়ে অনেক ঋণ বিতরণ হয়েছে, যা এখন ফেরত আসছে না। বর্তমানে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০১০ সালে আমি দায়িত্ব ছাড়ার সময় এটি মাত্র ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা বা ১০ শতাংশেরও কম ছিল। চেয়ারম্যান হিসেবে আমি নগদ আদায়, পুনঃতফসিল ও আইন অনুযায়ী ঋণ কমানোর চেষ্টা করছি।’ রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকও নিম্নমুখী অবস্থানে আছে। চলতি বছরের ছয় মাসে ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ১ হাজার কোটি টাকা কমে ৪৬ হাজার ৫২১ কোটি টাকায় নেমেছে। এর মধ্যে ২২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা খেলাপি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র রাষ্ট্রীয় ব্যাংক হিসেবে রূপালির খেলাপি ঋণের হার ৪৪ শতাংশ। সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭৬১ কোটি টাকায়।
রূপালী ব্যাংকের এমডি কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ভালো গ্রাহক দেখে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে ঋণ বিতরণ কিছুটা কম। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবও আছে।’ প্রবাসীদের ঋণ প্রদানের জন্য ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকও বিকশিত হতে পারেনি। ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর আগেই কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। অদক্ষ জনবল নিয়োগের ধকল এখনও কাটানো সম্ভব হয়নি। গত অর্থবছর পর্যন্ত ব্যাংকের আমানত স্থিতি ছিল মাত্র ১৭২ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। দেশের কৃষকদের ঋণ প্রদানের জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যাংকটি ভেঙে রাজশাহী অঞ্চলের শাখাগুলো নিয়ে ‘রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)’ গঠন করেন। কৃষি ব্যাংক এবং রাকাবের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে বেশ নাজুক।
কয়েক বছর ধরে বিশেষায়িত এই দুটি ব্যাংক একীভূত করার আলোচনা চলছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এখনো প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ ছিল বিকেবি ও রাকাবকে একীভূত করে কৃষকদের জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করা। কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ব্যাংকের সংখ্যা কমানো অনেক আমলার পছন্দ নয়। কারণ সংখ্যা কমে এমডি ও শীর্ষ নির্বাহীর পদও কমে যাবে। ডিএমডি, জিএমসহ অন্যান্য পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। একীভূত হলে পদ কমে যাওয়ার কারণে অনিয়মের সুযোগও কমে। তাই অনেক আমলা একীভূতকরণের বিপক্ষে রয়েছেন।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংস্কারে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘এনবিআরের সংস্কারকাজে ব্যস্ততার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারে সময় দেওয়া যায়নি। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের কাজ এগিয়ে গেছে। শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংকে রূপান্তরের উদ্যোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে সরকারি ব্যাংক সংস্কারে নজর দেওয়া হবে।’

