বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে আশঙ্কাজনক হারে আমানত উত্তোলন হলেও বেসরকারি তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংক—ইউসিবি, আইএফআইসি ও ইসলামী ব্যাংক—পরিচালনা পর্ষদ সংস্কারের পর আবার শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন পর এই ব্যাংকগুলো আবার আমানতকারীদের আস্থা অর্জন করছে।
বাংলাদেশের মোট ব্যাংকিং খাতের আমানতের প্রায় ১৫ শতাংশ এই তিন ব্যাংকের হাতে কেন্দ্রীভূত। ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে তারা দুই অংকের শক্তিশালী আমানত প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। তবে মূলধন ঘাটতি এখনও মারাত্মক। এ কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ সীমিত এবং নতুন আমানত থেকে আয় করার সক্ষমতাও এখনো পূর্ণ মাত্রায় নেই।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতি ও ঋণ প্রদানের অনিয়মের অভিযোগে তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের আগের বোর্ড ভেঙে দেয়। সেই সঙ্গে আগের নিয়ন্ত্রণকারীদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে ইউসিবি মুক্ত হয় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের প্রভাব থেকে। ইসলামী ব্যাংক মুক্ত হয় এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে, আর আইএফআইসি সরিয়ে নেয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারিখাত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণ।
এখন এই তিন ব্যাংকই রাইট শেয়ার, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সীমিত কার্যক্রম চালিয়ে যেতে ফরবিয়ারেন্স সুবিধা দিয়েছে। তবে প্রভিশন ঘাটতি এখনও রয়ে গেছে। নতুন শেয়ার বা বন্ড ইস্যুর জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহযোগিতা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী বলেন, “ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠনে পুঁজিবাজার হওয়া উচিত প্রথম ভরসা। তবে নতুন শেয়ার ইস্যুতে মালিকানা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় কিছু পরিচালক অপারগতা দেখাতে পারেন।
বর্তমান ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কিছু নিয়ম শিথিল করা উচিত বলে মনে করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, পর্যাপ্ত মূলধন ছাড়া ব্যাংক কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। ব্যাংক খাতের সার্বিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সমন্বিত বিবেচনা জরুরি।
তবে উচ্চ নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) এবং নিম্ন মূলধনের কারণে কয়েকটি ব্যাংককে বিএসইসি ইতোমধ্যে নতুন শেয়ার ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর ফলে মূলধন বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
কয়েকজন ব্যাংকার জানিয়েছেন, তারা বারবার চেষ্টা করেও বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে বৈঠক নিশ্চিত করতে পারেননি। যোগাযোগ করা হলেও মাকসুদ বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকের স্থিতিশীলতা রক্ষায় শেয়ার ইস্যু এবং নতুন বিনিয়োগকারীর ভূমিকা অপরিহার্য। তবে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা মূলধন বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করছে। এই পরিস্থিতি ব্যাংক খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ইউসিবি: আমানত বেড়েছে, কিন্তু মূলধন সংকট ঝুঁকি বাড়াচ্ছে:
দেশের শীর্ষ পাঁচ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে একটি ইউসিবি ২০২৫ সালের জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর সময়ে নেট আমানত পেয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৪ সালের পুরো বছরের ৪,০০০ কোটি টাকার তুলনায় এটি প্রায় তিনগুণ বেশি। সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংকটির মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ এসেছে রিটেইল গ্রাহকদের কাছ থেকে, যা ব্যাংকটির ওপর জনআস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিচায়ক।
তবে ব্যবসা সম্প্রসারণে মূলধন ঘাটতি এখন বড় বাধা। সেপ্টেম্বরের শেষে ইউসিবির সিআরএআর ছিল ৭.৬৯ শতাংশ, যা ন্যূনতম ১০ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শর্তের তুলনায় কম। সিআরআর, এসএলআর ও এডিআর—সব নিয়ম এখন ব্যাংক মেনে চলছে।
এই পরিস্থিতিতে জুন মাসে ইউসিবি ঘোষণা দিয়েছে, তারা পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশ সমমূল্যের শেয়ার কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে ইস্যু করবে। পাশাপাশি ৭৭৫ কোটি টাকার রাইট শেয়ার এবং ৮০০ কোটি টাকার সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে সিআরএআর ১২.৫ শতাংশের উপরে নেওয়া যায়। তবে চার মাস ধরে এই প্রস্তাব বিএসইসিতে ঝুলে আছে, কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত শর্তের কারণে।
ইউসিবির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাবিল মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিএসইসি অনুমোদনে দেরির কারণ হলো আগের বোর্ডের রেখে যাওয়া ১০ শতাংশের বেশি খেলাপি হার, চলমান লোকসান এবং স্পনসর শেয়ারহোল্ডিং ৩০ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া। আগের পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাংকের আর্থিক খাতকে বিপর্যস্ত করেছে। এগুলো রাতারাতি ঠিক করা সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “স্পনসর শেয়ারহোল্ডিং কমে যাওয়ায় আমরা নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনার পরিকল্পনা করছি। এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।” ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠনে নতুন বোর্ডের সংস্কারের উদ্যোগ বিবেচনায় রাখতে এবং রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদনের জন্য বিএসইসির শর্তগুলো শিথিল করা উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নাবিল মুস্তাফিজুর রহমান জানান, ইউসিবি ইতোমধ্যেই আমানতকারীদের আস্থা ফিরে পেয়েছে, যা আমানতের প্রবাহে প্রতিফলিত হচ্ছে কিন্তু মূলধনের ঘাটতি ব্যবসা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করছে, ফলে হাতে থাকা তারল্য থেকে আয়ের সুযোগও সীমিত।
তিনি বলেন, “আমরা যদি প্রতিযোগীদের মতো ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে না পারি, তবে ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় থাকবে। প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্প্রসারণে বিদেশি সফটওয়্যার কিনেছে, কিন্তু মূলধন সংকটে আমরা তা করতে পারিনি। এতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলধন বাড়ানো না হলে ব্যাংক লাভবান হতে পারবে না। শুধু প্রভিশন বা ফরবিয়ারেন্স সুবিধা নিয়ে টিকে থাকা কঠিন। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ইউসিবিতে আগ্রহী, তবে তারা চাইছেন ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে সংস্কারের ফলাফল দেখতে।
নাবিল মুস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেন, “মূলধন সংগ্রহ না হলে মুনাফা অর্জন বা প্রভিশন ঘাটতি পূরণ—কোনোটাই সম্ভব নয়। তাই কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনা এখন অত্যন্ত জরুরি।”
ইসলামী ব্যাংক: কীভাবে মূলধন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে:
এস আলম গ্রুপ–সংক্রান্ত দুর্নীতি প্রকাশের পর ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের আমানত প্রত্যাহার হয়েছিল। তবে ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে প্রায় ১৫ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নেট আমানত বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা—যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
বেঙ্গক সিআরআর ঘাটতি দূর করতে সক্ষম হয়েছে, সব বকেয়া পরিশোধ করেছে এবং রেমিট্যান্স আয়ের শীর্ষে ফিরে এসেছে। তবে দীর্ঘদিন গোপন রাখা খেলাপি ঋণের কারণে সিআরএআর নেমে এসেছে ৭ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ৮৬ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি পূরণের জন্য ফরবিয়ারেন্স দিয়েছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরতে শুরু করে। রেমিট্যান্স প্রবাহও পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখে।” তিনি জানান, শেয়ার লিকুইডেশনের পর ৮২ শতাংশ শেয়ার নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে ইস্যু করা হবে।
বর্তমানে ব্যাংক মূলধন সংগ্রহে সরাসরি পরিকল্পনা করতে পারছে না, তবে বিকল্প উপায় হিসেবে প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ার বা সাবঅর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর সম্ভাবনা বিবেচনা করছে। মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে ব্যাংক এখন এসএমই খাতে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
আইএফআইসি: আমানত ফিরছে, তবে সরকারি সহায়তার অপেক্ষায়:
২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন মাসে আইএফআইসি ব্যাংক প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার আমানত হারিয়েছিল। তবে এরপর ব্যাংকটি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। গত এক বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে। সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংকের মোট আমানত বেড়ে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি দাঁড়ায়, যা ২০২৪ সালের অক্টোবরের ৪৫ হাজার কোটি টাকার চেয়ে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
বোর্ড সংস্কারের মাধ্যমে সালমান এফ রহমানের প্রভাবমুক্ত হওয়া ব্যাংকটি ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে আবার ঋণ বিতরণ শুরু করে। দীর্ঘ সময়ের তারল্য সংকট শেষে ব্যাংকটি কার্যক্রমে ফিরেছে। ব্যাংক ১৭ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরবিয়ারেন্স সুবিধা পেয়েছে। তবে যথেষ্ট মূলধন না থাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণে এখনও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মনসুর মোস্তফা বলেন, “আমরা সরকারের থেকে মূলধন সহায়তা চাই, কারণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৩০ শতাংশের বেশি। আমাদের লক্ষ্য কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা। তবে আগে আর্থিক সূচকগুলো আরও শক্তিশালী করতে হবে।”
তিনি আরও জানান, আইএফআইসি এখন এসএমই ঋণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দেশের গ্রামীণ এলাকায় বিস্তৃত ১,২০০টির বেশি উপশাখা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলধন সংক্রান্ত সরকারি সহায়তা ছাড়া ব্যাংক পুরোপুরি ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে না। তবে ইতোমধ্যেই আমানতের পুনরুদ্ধার এবং ঋণ বিতরণের শুরু ব্যাংকের স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

