জনতা ব্যাংক লিমিটেড বেক্সিমকো লিমিটেডের ছয়টি কারখানা নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকের এই পদক্ষেপটি এসেছে সরকারি পুনরায় চালুর উদ্যোগকে উপেক্ষা করে।
গত ২১ নভেম্বর কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেল লিমিটেডের ইউনিট–১ ও ইউনিট–২, আরবান ফ্যাশনস লিমিটেড এবং অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেডের ঋণ ও সুদসহ পাওনা আদায়ে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আগ্রহী ক্রেতাদের আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দরপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
গত ২০ নভেম্বর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই নিলামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওইদিন জনতা ব্যাংক বেক্সিমকোর তিনটি কারখানার জন্য জামানত হিসেবে দেওয়া ১৯৩ শতাংশ জমি এবং তার ওপর থাকা সব স্থাপনা নিলামের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আরও তিনটি কারখানার নিলাম শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।
মূলত, ২০ নভেম্বরের সভাটি ১৮ নভেম্বর আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। ওই সভার মূল এজেন্ডা ছিল বেক্সিমকোর সম্পদ নিলামের পরিবর্তে, বেক্সিমকো লিজ নিতে আগ্রহী জাপানি প্রতিষ্ঠান রিভাইভাল এবং জনতা ব্যাংকের মধ্যে চুক্তির খসড়া অনুমোদন। তবে সভা স্থগিত করে নতুন এজেন্ডা হিসাবে বেক্সিমকোর ঋণ আদায়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তোলার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জনতা ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. মজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সরাসরি মন্তব্য করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ম্যাসেজের উত্তরে ফোন করলে তিনি জানান, মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় পরে বিস্তারিত জানাবেন। এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি।
নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে যা আছে:
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেড বেক্সিমকো লিমিটেডের ছয়টি কারখানা নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকের এই পদক্ষেপ এসেছে সরকারি পুনরায় চালুর উদ্যোগকে উপেক্ষা করে। গত ২১ নভেম্বর কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জনতা ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেল লিমিটেডের ইউনিট–১ ও ইউনিট–২-এ ব্যাংক ৫৪৩.৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। সুদসহ এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৭৫৪.৭০ কোটি টাকা।
আরবান ফ্যাশনস লিমিটেডের ২৫২.৪৫ কোটি টাকার ঋণ সুদসহ বেড়ে হয়েছে ৭২৪.২৬ কোটি টাকা। অ্যাপোলো অ্যাপারেলস লিমিটেডের ২৫১.২৬ কোটি টাকার ঋণ সুদসহ দাঁড়িয়েছে ৮১৬.৪০ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে এই তিন কারখানার জন্য ৩,২৯৫ কোটি টাকা আদায়ের জন্য সমস্ত মেশিনপত্র, মজুদ মালামাল, গাজীপুরের কাশিমপুরে অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৯৩ শতাংশ জমি এবং সেখানে নির্মিত ও নির্মাণাধীন স্থাপনা নিলামে তোলা হয়েছে।
এর পাশাপাশি ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেডের কাছে ১,৩৯৭ কোটি টাকা, অ্যাসেস ফ্যাশন লিমিটেডের কাছে ১,১৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের কাছে ১,৩১৬ কোটি টাকা পাওনা আদায়ের জন্যও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জমাকৃত স্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে।
কারখানা পুনরায় চালুর সরকারি উদ্যোগ:
হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি আয় ধরে রাখতে বেক্সিমকো লিমিটেডের আন্তর্জাতিক মানের টেক্সটাইল কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেন শ্রম মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে।
গত মে মাসে জাপানি প্রতিষ্ঠান রিভাইভাল প্রজেক্ট লিমিটেড বেক্সিমকোর কারখানা লিজ ভিত্তিতে চালুর প্রস্তাব দিয়ে সরকারের কাছে আগ্রহপত্র (ইওআই) জমা দেয়। বেক্সিমকো লিমিটেডও সরকারের কাছে লেটার অব কমফোর্ট প্রদান করে। এরপর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানাগুলো চালুর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২২ জুলাই শ্রম মন্ত্রণালয় প্রথম বৈঠক করে অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের সঙ্গে। পরবর্তী কয়েক দফা বৈঠকেও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বেক্সিমকোর কারখানা চালুর বিষয়ে সম্মত হয়।
২০২৪ সালের নভেম্বরে গঠিত ১১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিও বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রিভাইভালের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এর পাশাপাশি গত ৩০ জুন গঠিত ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, বন্দর ও রাজস্ব কার্যক্রম গতিশীলকরণে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও কারখানা পুনরায় চালুর পক্ষে মত প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকও কয়েকটি বৈঠক করে এবং জানায়, বেক্সিমকো তার কারখানাগুলো লিজ দিতে পারবে।
রিভাইভাল প্রাথমিকভাবে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করবে। পরবর্তীতে বিনিয়োগ ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। রিভাইভালের উদ্যোগে অর্থায়ন করবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইকোমিলি। বেক্সিমকোর বিদেশি বায়াররাও কারখানা চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। খসড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে—রিভাইভাল কারখানাগুলো পরিচালনা করে রপ্তানি আয়ের ১.৫ থেকে ২.৫ শতাংশ কমিশন নেবে। পরিচালন ব্যয় বাদে বাকি অর্থ দিয়ে জনতা ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হবে। কোনো অংশ বেক্সিমকো পাবেনা।
ইতোমধ্যে লিজ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ৮ অক্টোবর রিভাইভাল, বেক্সিমকো গ্রুপ ও জনতা ব্যাংকের মধ্যে চুক্তির খসড়া তৈরি হয়। খসড়াটি অনুমোদনের জন্য ১৮ নভেম্বর বোর্ড সভার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সভা স্থগিত হয়। পরে ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় এজেন্ডা পরিবর্তন করে বেক্সিমকোর কারখানা ও জামানত হিসেবে থাকা স্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

