এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছে। শাখাবিহীন এই সেবায় ব্যাংকগুলোও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলারের প্রভাব পড়েছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে। এতে কিছুটা কমেছে এজেন্ট ও আউটলেটের সংখ্যা। তথ্যটি পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় মাস ধরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে এজেন্ট ও আউটলেটের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অর্থাৎ নতুন এজেন্ট ও আউটলেটের সংযোজনের চেয়ে বেশি বন্ধ হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের হিসাব অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত ও ঋণ বিতরণ কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু এজেন্ট ও আউটলেটের সংখ্যা কমেছে।
এ পর্যন্ত ৩১টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালাচ্ছিল। গত জুনে একটি ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল হওয়ায় এখন ৩০টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এসব ব্যাংকের মোট এজেন্টের সংখ্যা কমে হয়েছে ১৫ হাজার ৩২১টি, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১৫ হাজার ৩৭৩টি। অর্থাৎ আগের প্রান্তিকের তুলনায় কমেছে ৫২টি। বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা কমেছে ১ হাজারেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সাম্প্রতিক একটি সার্কুলারে বলা হয়েছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আউটলেটে নারী ও পুরুষের সংখ্যা সমান হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, দুজন পুরুষকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিলে সমান সংখ্যক নারীও নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান মো. ফিরোজ চৌধুরী বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গতি বাড়ছিল, কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ ধীর হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের প্রভাব এতে পড়েছে। তবে আমানত ও ঋণ বিতরণ বেড়েছে, যা ইতিবাচক। যদি সার্কুলারে কিছুটা নমনীয়তা থাকে, তাহলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গতি আবার বেড়ে যাবে।” বর্তমানে ব্যাংকগুলো শাখাবিহীন ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকছে। এতে ব্যাংকের খরচ কমছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে। তবে সাময়িকভাবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গতি কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত বাড়লেও ঋণ বৃদ্ধি তেমন নেই। ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ কমে যাওয়ার মানে হলো এ সেবার গতিতে কিছুটা ধীরগতি এসেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নীতিমালার প্রভাবেই কার্যক্রম কিছুটা কমেছে। তবে তারা জোর দিয়ে বলছেন, “আমানত ও ঋণ বিতরণের বৃদ্ধি এখন পর্যন্ত ইতিবাচক।“
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে মূলত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীই আমানত রাখছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে মোট আমানত ৪৭ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর। শহরাঞ্চলের আমানত মাত্র ৮ হাজার ২১ কোটি টাকা। মোট আমানতের প্রায় ৮৫ শতাংশই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর। ঋণ বিতরণও কিছুটা বেড়েছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে ১১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, যা জুন প্রান্তিকে ছিল ১০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা।
এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম ২০১৪ সালে চালু হয় সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতে। গ্রাহককে কোনো অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয় না। তারা ব্যাংকের ডেবিট কার্ডও ব্যবহার করতে পারছেন। সেবাটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরিচালন ব্যয় কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোও এতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে গ্রাহক সংখ্যা ও লেনদেনের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আমানত সংগ্রহ করতে অনেক ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং বেছে নিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাম থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ হিসেবে দেয়। এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যাংকের জন্য লাভজনক, কারণ এতে অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। গ্রাহকরাও সহজেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন। ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারির পর ২০১৪ সালে প্রথম এ সেবা চালু করে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়া। বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এরপরেই রয়েছে ব্যাংক এশিয়া এবং ইসলামী ব্যাংক।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, দেশের ভেতর টাকা স্থানান্তর, রেমিট্যান্স উত্তোলন, বিভিন্ন মেয়াদি আমানত প্রকল্প চালু, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বিভিন্ন ঋণ উত্তোলন ও পরিশোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তা ভর্তুকি গ্রহণ করা যায়। এজেন্টরা চেক বই বা ব্যাংক কার্ড ইস্যু করতে পারেন না এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত লেনদেন করতে পারবে না। এজেন্টদের আয়ের উৎস মূলত মোট লেনদেনের ওপর পাওয়া কমিশন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি এজেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একটি চলতি হিসাব থাকতে হয়। এ ছাড়া এজেন্টরা ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ আবেদন, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের নথিপত্র সংগ্রহ করতে পারছেন।

