একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্তে কর্মীদের মধ্যে গভীর হতাশা ও চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তাদের জীবনযাপন আরও কঠিন করে তুলবে। তবে চাকরি হারানোর আশঙ্কায় কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না।
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা এবং পাঁচ ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমাতে বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসকদের সঙ্গে এক বৈঠকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই সিদ্ধান্ত জানান। ভয়াবহ তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো কর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমানতকারীদের সুরক্ষা বিবেচনায় গভর্নর এ নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়েছে।
কর্মকর্তাদের ক্ষোভ: ‘দুর্নীতির দায় চাপানো হচ্ছে নিরীহ কর্মীদের ওপর’
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যারা ব্যাংকগুলো লুটপাট করেছে, দুর্নীতি করেছে, বিদেশে টাকা পাচার করেছে—দায় তাদেরই। কিন্তু শাস্তি দেওয়া হচ্ছে সাধারণ কর্মীদের। আমাদের তো কোনো দায় নেই। এতে ভেতরে ভেতরে হতাশা বাড়ছে। কিন্তু চাকরির ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।’
এক্সিম ব্যাংকের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছর ধরে তাদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি বন্ধ। এতে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে তাদের চলতে হচ্ছে। এর মধ্যে যদি বেতন আরও কমানো হয়, তাহলে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠবে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, এই সময়ে বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অযৌক্তিক। তারা বলেন, ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রাথমিক আলোচনায় বলা হয়েছিল—তিন বছরের মধ্যে কোনো কর্মী চাকরি হারাবেন না, বেতনও কমানো হবে না। এখন সেই কথারই ব্যত্যয় ঘটেছে।
‘শকিং সিদ্ধান্ত’: সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও অভিজ্ঞ ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। রেজলুশন প্ল্যান তৈরির সময় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় তাৎক্ষণিক বেতন কমানোর কথা ছিল না। আলোচনায় বলা হয়েছিল প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ স্তরের বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হতে পারে। কিন্তু এক মাস না যেতেই হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া শকিং।’
তিনি আরও বলেন, গভর্নর আগে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে দুই-তিন বছর কোনো কর্মী বেতন কমানো বা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকবেন না। এখন সেই আশ্বাসের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। তার মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত মার্জার প্রক্রিয়া অগ্রসর হওয়ার পর নিলে বেশি যুক্তিযুক্ত হতো।
ব্যাংকগুলোর সংকট: তারল্য ঘাটতি ও বিপুল খেলাপি ঋণ
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, তীব্র তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলো আমানতকারী, সরকারি সংস্থা ও নিজস্ব কর্মীদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। প্রশাসকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে আমানতকারী ও কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৩২৫ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। এই অর্থ নতুন গঠিত ব্যাংকের বরাদ্দ থেকে সমন্বয় করা হবে।
বর্তমানে পাঁচ ব্যাংকে ৭৫ লাখ আমানতকারীর জমা রয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা—অর্থাৎ ৭৬ শতাংশ—খেলাপি।
খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক (৯৮%)। এরপর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (৯৭%), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (৯৫%), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (৬২.৩০%) এবং এক্সিম ব্যাংক (৪৮.২০%)।
এই পাঁচ ব্যাংকে মোট জনবল প্রায় ১৫ হাজার। তাদের রয়েছে ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট আউটলেট ও ৯৭৫টি এটিএম বুথ।
কেন একীভূত করা হচ্ছে?
গত সরকারের সময়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তারা আমানতকারীদের চাহিদামতো টাকা ফেরত দিতেও ব্যর্থ হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বর্তমান সরকার ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
চলতি মাসের শুরুতে পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং এমডিরা পদত্যাগ করেন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত প্রশাসকরা একীভূতকরণের কাজ পরিচালনা করছেন।
জানা গেছে, নতুন শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নাম হতে যাচ্ছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ব্যাংকের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগানের প্রস্তাব দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন ব্যাংকের হিসাব খোলা হলে সেই হিসাবে অর্থ ছাড় করা হবে।

