বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মাত্র এক বছরে ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে খেলাপির হার ১০ শতাংশ থেকে লাফিয়ে প্রায় ৬১ শতাংশে উঠে গেছে। ব্যাংকিং রিফর্ম টাস্কফোর্সের নির্দেশে চলমান বিদেশি অডিট ফার্মের ফরেনসিক অডিটের সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ পুনঃশ্রেণিবিন্যাসে এই ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী আইএফআইসি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। সেই সময় এই বিপুল ঋণের বড় একটি অংশ খেলাপি হলেও তৎকালীন ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সেগুলোকে নিয়মিত হিসেবে দেখানো হয়।
ব্যাংকের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আইএফআইসি ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৫৫ কোটি টাকা এখন খেলাপি, যা মোট ঋণের ৬০.৬৩ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপির হার ছিল মাত্র ৯.৯২ শতাংশ বা ৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫১৬.৪২ শতাংশ, যার পরিমাণ ২২ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।
সরকারের ব্যাংকিং রিফর্ম টাস্কফোর্সের সুপারিশে ব্যাংকটিতে বিদেশি অডিট ফার্ম ফরেনসিক অডিট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, অডিটররা ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান থেকে শুরু করে ঋণের শ্রেণিবিন্যাস পর্যন্ত সব কিছু যাচাই করছেন। জানা যায়, আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সালমান এফ রহমান ২৯টি বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলে জামানত ছাড়াই ১৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার ঋণ নেন। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে সরাসরি ঋণ নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় তিনি এই পথ বেছে নেন।
এই ২৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি খোলা হয় ২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। মাত্র এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করা হয়। ব্যাংক সে সময় কোনো ধরনের ডিউ ডিলিজেন্স বজায় রাখেনি। অভিযোগ রয়েছে, ঋণের অর্থ ব্যবসায়িক কাজে না লাগিয়ে বেক্সিমকোর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়। ফলে এসব ঋণ এখন পুরোপুরি খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এবং ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
এতে আইএফআইসি ব্যাংক প্রভিশন রাখা এবং নিরাপত্তা সঞ্চিতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকটে পড়ে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাত্র ৫৭৪ কোটি টাকার ঘাটতির তুলনায় প্রায় ১৮ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা বেশি। প্রভিশনের পাশাপাশি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিও বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা।
এই ঘাটতি কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে একটি কর্মপরিকল্পনা চেয়েছে। তবে ব্যাংক জানিয়েছে, ঘাটতি পূরণে তাদের ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, এ সময়সীমা বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এমন ধরনের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ব্যাংক রেজুলেশন ডিপার্টমেন্টে (বিআরডি) পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর) সুদ আয় না থাকায় ব্যাংকটি বড় ধরনের লোকসানে পড়ে। এই সময়ে লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যেখানে গত বছরের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৭০ কোটি টাকা। এ সময় ব্যাংকের নিট সুদ আয় ঋণাত্মক ১ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা হয়। অর্থাৎ সুদ ব্যয় সুদ আয়ের চেয়ে বেশি ছিল।
আইএফআইসি ব্যাংকের ডিএমডি ও মুখপাত্র রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নতুন করে ঋণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং খারাপ ঋণ শনাক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করে। তার দাবি, অনেকে বিদেশে পালিয়ে থাকায় বা আত্মগোপনে থাকায় ঋণ আদায় সম্ভব হয়নি, তাই খেলাপি বেড়েছে। তবে ২৪টি মামলা করার পর অর্থ আদায় শুরু হয়েছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপির হার ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা করছেন তিনি।

