বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক কোম্পানি আইনে ৪৫টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। এই সংশোধনী কার্যকর হলে দেশের সব ব্যাংক—রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি—একই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আসবে। কয়েক দশকের মধ্যে এটিকে সবচেয়ে ব্যাপক ব্যাংক সংস্কার উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে এবং এখন তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শিগগিরই সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতামতের জন্য খসড়া উন্মুক্ত করা হবে। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতামত সংগ্রহের পর খসড়া মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে।
সবচেয়ে বড় প্রস্তাব হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা বাতিল করা। বর্তমানে ‘বিশেষায়িত ব্যাংক’ হিসেবে তারা মূলধন সংরক্ষণ, শাসনব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণবিধিতে নানা ছাড় পেয়ে থাকে। নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক একই মূলধন মান, একই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং একই শাসননীতি মেনে চলবে।
এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষেত্রে এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক হবে। আগে এ ধরনের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল না। নতুন আইনের আওতায় সরকার আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির জন্য স্বতঃসিদ্ধভাবে ছাড় পেতে পারবে না।
প্রস্তাবিত সংশোধনীর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক বা সিইও হতে চাইলে তার অভিজ্ঞতা কমপক্ষে ১৫ বছর হতে হবে, আগে যা ১০ বছর ছিল। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আর কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। এতে ঋণ অনুমোদনে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে।
পরিবারতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একজন পরিবারের সর্বাধিক দুইজনকে পরিচালক করা যাবে। ‘পরিবার’ সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির সদস্য যেমন জামাই, পুত্রবধূ, ভাশুর বা ননদও এ বিধানের আওতায় আসবে। ফলে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিচালকের পদ নেওয়ার পথ বন্ধ হবে। এছাড়া পরিচালকের টানা মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করা হচ্ছে। এরপর তিন বছরের বিরতির পর পুনরায় নিয়োগ সম্ভব হবে।
বোর্ডের আকারও ছোট করা হবে। বর্তমানে ২০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ কমিয়ে ১৫ সদস্য করার প্রস্তাব রয়েছে। এর অর্ধেক সদস্য হবে স্বতন্ত্র পরিচালক, যেখানে এখন মাত্র তিন জন বাধ্যতামূলক। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তৈরি প্যানেলের তালিকা থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক বাছাই করা হবে, যাতে বোর্ডে পেশাদারিত্ব বাড়ে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছোট বোর্ড সবসময় বেশি কার্যকর। তাদের মতে, ১১ সদস্যই আদর্শ সংখ্যা। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কেবল পরিচালকদের সংখ্যা নয়, বরং তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা।
২০২৩ সালে চালু করা ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ শ্রেণি বাতিল করার প্রস্তাব এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, এই শ্রেণি নির্ধারণে স্পষ্ট মানদ- না থাকায় অতিরিক্ত জটিলতা তৈরি হচ্ছে এবং দুর্নীতির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, ঋণখেলাপির আলাদা কোনো শ্রেণি থাকবে না। সব ঋণখেলাপি একই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার নির্দিষ্ট মানদ- না থাকার কারণে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।’
শেয়ার মালিকানা নিয়ন্ত্রণেও কড়াকড়ি আনা হচ্ছে। একজন বিনিয়োগকারী সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার রাখতে পারবেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন মনে করলে ‘কৌশলগত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী’দের ক্ষেত্রে এই সীমা শিথিল করতে পারবে। এতে বড় দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর ঋণ নেওয়ার নিয়মও কঠোর করা হয়েছে। বর্তমানে একটি কোম্পানি ঋণখেলাপি হলেও একই গোষ্ঠীর অন্য কোম্পানি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হলে পুরো গোষ্ঠীর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানও ঋণ পাবেনা।
১৯৯৬ সালে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ব্যাংক সংস্কার কমিটি সুপারিশ করেছিল, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি পরিচালনা পর্ষদে থাকা উচিত নয়। তার মতে, দীর্ঘ সময় একই ব্যক্তি পরিচালনা পর্ষদে থাকলে পরিবারতন্ত্র বৃদ্ধি পায় এবং ব্যাংকের শাসনব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালকরা টানা ১২ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এটি কমিয়ে ৬ বছর করা হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) মনে করছে, মেয়াদ ৯ বছর রাখা উচিত। তাদের দৃষ্টিতে মেয়াদ কমালে অভিজ্ঞতার ঘাটতি তৈরি হতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা এ যুক্তি গ্রহণ করছেন না। তাদের মতে, দীর্ঘ মেয়াদই পরিবারতন্ত্র ও অনিয়ম বাড়িয়েছে। ২০১৮ সালের আগে পরিচালকের একটানা মেয়াদ ছিল ৬ বছর। ২০১৮ সালে তা ৯ বছর করা হয়। ২০২৩ সালে আবার পরিবর্তন করে ১২ বছর করা হয়। ওই বছর ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল জাতীয় সংসদে তোলার সময় ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে প্রস্তাবিত ৪৫টি সংশোধনীকে বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের জন্য একই নিয়ম চালু করা, স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বাড়ানো, পরিবারতন্ত্র কমানো এবং ঋণনীতিতে কঠোরতা—সব মিলিয়ে এ সংস্কার কার্যকর হলে দেশের ব্যাংক খাত আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রস্তাবনায় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আর ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, “প্রস্তাবটি সঠিক দিকেই নেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা কেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হবেন? তাদের অনেকেরই নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। এখানে অবশ্যই পেশাদার লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন, যাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত নয়।” তিনি আরও বলেন, “অতীতে যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে পরিচালিত হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা ও আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখা জরুরি।”
ব্যাংকের পরিচালকের টানা দায়িত্ব পালন করার মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ করার প্রস্তাব নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, “এটি আগে ৬ বছরই ছিল। বিগত সরকার কিছু ব্যক্তিকে সুবিধা দিতে মেয়াদ ১২ বছর করেছিল। এখন এই মেয়াদ আরও কমানো উচিত।” ২০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ কমিয়ে ১৫ করার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, “এ প্রস্তাবটি ঠিক আছে। তবে বোর্ড আরও ছোট করা যায়, ১০ জনই যথেষ্ট।”
এক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হলে একই গ্রুপের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ না দেওয়ার সংশোধনী প্রস্তাবকেও তিনি সময়োপযোগী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আগে এমন নিয়ম ছিল না। দেখা যেত, একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হওয়ার পরও একই গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ঋণ পেত। এটি পরিবর্তন করা জরুরি ছিল।”

