সরকার পরিবর্তনের পর ঋণ প্রদানের শর্ত শিথিল হওয়ায় ব্যাংকগুলিতে আমানতের প্রবণতা বেড়েছে কিন্তু সেই আমানত বিনিয়োগে রূপান্তরিত না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের আগস্টে এই অতিরিক্ত তারল্য ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে পৌঁছেছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয়কারীদের কাছে উচ্চ সুদ প্রদানের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংকগুলো সঞ্চয়কারীদের ৮–১০ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের ব্যয়কে কয়েকগুণ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের আগস্টে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ১১২ কোটি টাকা। তুলনামূলকভাবে, গত বছরের একই সময়ে এটি ছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। তবে সব ব্যাংকই অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগে ব্যবহার করেনি। কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অর্থ সংরক্ষণ করেছে। ফলে আগস্টে মোট তারল্য দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকায়, যেখানে প্রকৃত চাহিদা ছিল মাত্র ২ লাখ ২৬ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।
সরকারের পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কার ও পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ এখনও স্থিতিশীল হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী। তিনি বলেন, “উচ্চ সুদের হার, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগের পূর্ব হিসাবনিকাশের কারণে অনেকেই ঋণ নিতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকে মোটা অঙ্কের টাকা অলস পড়ে রয়েছে। এসব টাকার কোনো অর্থনৈতিক বা উৎপাদনশীল ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ গ্রাহকের জমা হওয়া অর্থের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে সুদ দিতে হচ্ছে। আশা করা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হলে ঋণের চাহিদা বাড়বে এবং অতিরিক্ত তারল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে। তখন ব্যাংকের সুদদণ্ডও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।”
সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্ট শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৩ কোটি টাকা। প্রচলিত ধারার ৪৩ বেসরকারি ব্যাংকে তা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫১ কোটি, ১০টি ইসলামি ব্যাংকে ৬ হাজার ৫০৯ কোটি এবং ৯টি বিদেশি ব্যাংকে ৩২ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। ব্যাংকভিত্তিক অবস্থান অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য সর্বোচ্চ ৬২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে:
- ব্র্যাক ব্যাংক: ১৮ হাজার ৮৭৭ কোটি
- পূবালী ব্যাংক: ১৮ হাজার ৩৯৮ কোটি
- অগ্রণী ব্যাংক: ১৮ হাজার ৩৫১ কোটি
- ব্যাংক এশিয়া: ১৭ হাজার ৯০৫ কোটি
- ডাচ্-বাংলা ব্যাংক: ১৬ হাজার ২২০ কোটি
- যমুনা ব্যাংক: ১৪ হাজার ৮০১ কোটি
- রূপালী ব্যাংক: ১২ হাজার ৫৫৩ কোটি
- সিটি ব্যাংক: ১২ হাজার ৪৮১ কোটি
- স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক: ১২ হাজার ৩৫৯ কোটি
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকের হাতে থাকা অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগে রূপান্তরিত না হলে সুদ চাপ বেড়ে যাবে এবং ব্যাংকগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। সঠিক বিনিয়োগ ও ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি ছাড়া এই অতিরিক্ত অর্থ অর্থনৈতিক কার্যকারিতায় যুক্ত হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ৪ শতাংশ নগদে এবং ১৩ শতাংশ ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে রাখতে হয়। স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) ও ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) পূরণ করার পর হাতে থাকা অতিরিক্ত অর্থই ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্টে আমানতে বৃদ্ধি হয়েছে ১০.২ শতাংশ এবং ঋণে বৃদ্ধি ৮.২৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ৮.৫ থেকে ৯.৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। উল্লেখযোগ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিক বলেন, “বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। যদিও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিনিয়োগ অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকগুলো ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বাড়লে ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।”
বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ সুদ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগের পূর্ব হিসাবনিকাশের কারণে ঋণের চাহিদা কম থাকায় ব্যাংকগুলোর হাতে মোটা অঙ্কের অলস অর্থ জমে রয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী জানান, “এই অতিরিক্ত তারল্য অর্থনৈতিক বা উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হলে ঋণের চাহিদা বাড়বে এবং ব্যাংকের সুদদণ্ডও নিয়ন্ত্রণে আসবে।” এতে বোঝা যাচ্ছে, ব্যাংক খাত বর্তমানে অতিরিক্ত তারল্য ও সুদ চাপের মধ্যে রয়েছে। সঠিক বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় ব্যাংকগুলোকে উচ্চ সুদ দিতে হচ্ছে, যা তাদের ব্যয়কে বাড়াচ্ছে। তবে বিনিয়োগ বাড়লে এই চ্যালেঞ্জ স্বাভাবিকভাবে কমবে।
দেশের ব্যাংক খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ স্থিতিশীল না থাকায় ঋণ বিতরণ বাড়ছে না, অথচ আমানত প্রবাহ কমছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে জমে থাকা অতিরিক্ত তারল্য ক্রমেই অনুভূত চাপ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। পরিস্থিতি বদলালেই উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহী হবেন এবং ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক ঋণচক্রে ফিরতে পারবে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হলে ঋণের চাহিদা বাড়বে; এতে অতিরিক্ত তারল্যের বোঝাও কমবে। তখন আমানতের বিপরীতে ব্যাংক যে উচ্চ সুদ দিতে বাধ্য হয়, সেই ব্যয়ও কার্যত শূন্যে নেমে আসবে।
রাজনৈতিক পালাবদলের পর দুর্বল ব্যাংকগুলোর নানান অনিয়ম ও দুর্বলতা প্রকাশ্যে আসে। এতে বহু আমানতকারী তাঁদের টাকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়ে বড় অঙ্কের আমানত সরিয়ে নেন। ফলে দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা উঠে গিয়ে তুলনামূলকভাবে সুস্থ ব্যাংকগুলোয় আমানত দ্রুত জমতে থাকে। এই দ্রুত প্রবাহ তারল্য বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু সেই অনুপাতে ঋণ বাড়ানো সম্ভব হয় না। কারণ, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই-বাছাই, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং উপযুক্ত গ্রাহক বেছে নিতে সময় লাগে। ফলে ঋণপ্রবাহ কিছুটা ধীর হলেও আমানত সংগ্রহ থেমে না থাকায় তারল্য ধীরে ধীরে পাহাড়ে পরিণত হয়। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ না থাকলে এই তারল্যই ব্যাংকের জন্য আর্থিক চাপ তৈরি করে।
এ পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংক ঋণ বিতরণ বাড়াতে না পারায় অলস অর্থ অকার্যকর হয়ে না পড়ে—এই লক্ষ্যে সরকারি সিকিউরিটিজ, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এতে ব্যাংক অন্তত কিছু আয় নিশ্চিত করতে পারে। কারণ, আমানতকারীদের টাকা যতক্ষণ ব্যাংকে থাকে, ততক্ষণই ব্যাংককে সুদ দিতে হয়। বিনিয়োগ স্থবির থাকলে এই সুদের ব্যয় বেড়ে ব্যাংকের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
তবে অর্থনীতিতে গতি ফিরলে এবং বিনিয়োগের পরিবেশ স্পষ্ট হলে বর্তমানে ব্যাংকের হাতে জমে থাকা এই অতিরিক্ত তারল্যই আশীর্বাদে পরিণত হতে পারে। নতুন বিনিয়োগ বাড়লে ঋণের চাহিদা বাড়বে, আর তখন আজকের অতিরিক্ত তারল্য আর উদ্বৃত্ত থাকবে না; বরং ব্যাংক খাতকে পুনরায় স্বস্তির অবস্থানে ফিরিয়ে আনবে।

