অনেক চড়াই-উতর পেরিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে দুর্বল পাঁচটি ব্যাংককে নিয়ে গঠিত নতুন ব্যাংক ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। ইতিমধ্যেই প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ পর্ষদ সভায় সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর গত সোমবার ব্যাংকটিকে তফসিলি ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসেও ব্যাংকটি নিবন্ধিত হয়েছে। জানা গেছে, শিগগিরই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সভার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু হবে।
নতুন করে যাত্রা শুরু হওয়ায় পাঁচটি ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন জন্মেছে। তারা জানতে চাইছেন—কবে থেকে টাকা উত্তোলন করা যাবে এবং জমা রাখা অর্থ কবে মিলবে। একই সঙ্গে তাদের মনে প্রশ্ন আছে, নতুনভাবে চালু হওয়া ব্যাংকটির গতিপ্রকৃতি কেমন হবে, নতুন আমানত রাখা ঠিক হবে কি না।
অন্যদিকে, পাঁচটি ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, চাকরি থাকবে কি না এবং বেতন-ভাতা নিয়মমতো দেওয়া হবে কি না। ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে, পাঁচটি ব্যাংকের কর্মীদের বেতন ২০ শতাংশ কমানো হবে। এই ঘোষণা তাঁদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোতে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা নতুন ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর এ মুহূর্তে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্কও শুরু হয়েছে।
বিতর্কের মূল কারণ তিনি একটি রাজনৈতিক দল-সংলগ্ন প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হওয়া। জানা গেছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের আগে ড. আইয়ুব মিয়া খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ৩০ নভেম্বর ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়াকে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। তবে নিয়োগের পরপরই বিতর্ক শুরু হয়। কারণ তিনি বর্তমানে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ইবনে সিনা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি ইবনে সিনা ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য। লিংকডইন প্রোফাইল ও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে তার এই দায়িত্বের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানগুলো জামায়াত-সংলগ্ন হিসেবে পরিচিত, তাই তাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল পাঁচটি ব্যাংক নিয়ে ইতিমধ্যেই গ্রাহকসহ সারা দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা রয়েছে। তার ওপর শুরুতেই ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে তা সুখকর নয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে আইয়ুব মিয়াকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে। তাকে দিয়ে ব্যাংকটির পথচলা ভালোভাবে শুরু হবে বলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে নিয়োগের পরই বিতর্ক ওঠায় কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠতে পারে। শুরুতে বিতর্ক হলে নতুন ব্যাংকটির প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। তাই ব্যাংকের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথেষ্ট ভাবনা করা জরুরি।”
নতুন ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে একীভূত হয়ে যাওয়া পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে—এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, একীভূত ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্য বিশেষ স্কিম ঘোষণা করা হবে। এতে টাকা উত্তোলনের পদ্ধতি, মুনাফার হার ও অন্যান্য শর্ত বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। দুই লাখ টাকার বেশি আমানতকারী বাকি অর্থ ধাপে ধাপে তুলতে পারবেন।
সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট থেকে সরকার ইতিমধ্যেই ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে। বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানতকারীদের শেয়ার হিসেবে। ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সরকারি তহবিল ব্যাংকে রাখা হবে। এছাড়া আকর্ষণীয় মুনাফার মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীদেরও সঞ্চয় রাখায় উৎসাহিত করা হবে। পাশাপাশি ঋণ আদায় ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকের তরল সম্পদ বাড়ানোর কাজও চলবে।
চলতি বাজেটে ইকুইটি-মূলধন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্য থেকেই ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটি লাভজনক হলে সরকারের বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা পাওয়া যাবে। পরিকল্পনা রয়েছে, তিন বছর পর ব্যাংক স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হলে সরকারের দেওয়া ২০ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বেসরকারি খাতে ছাড় করা হবে।
কর্মীদের বেতন-সুবিধায় সম্ভাব্য কাটছাঁট:
একীভূত হওয়া পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের কর্মীদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধায় কাটছাঁট হতে পারে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে।
পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসকরা ১ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধুমাত্র কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্য ৩৫০ কোটি টাকা ছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে। খুব শিগগিরই বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে। যদি তা হয়, ব্যাংকগুলোতে কর্মরতদের বেতন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। পাঁচ ব্যাংকে প্রায় ১৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকে বর্তমানে ৭৫ লাখ আমানতকারীর জমা আছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণের বেশিরভাগ পূর্ববর্তী মালিক পক্ষ ইতিমধ্যেই বের করে নিয়েছে। ফলে এখন ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। দেশব্যাপী এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। একীভূত হওয়ার পর একই এলাকায় একাধিক শাখা একত্রিত করে একটি বা দুটি শাখা করা হবে।
আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হবে আমানত ফেরত:
একীভূত হওয়া পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের টাকা আগামী সপ্তাহ থেকে ফেরত দেওয়া শুরু হবে। অর্থ প্রদান ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর মাধ্যমে হবে। এর আগে দেশজুড়ে পাঁচ ব্যাংকের সব সাইনবোর্ড একযোগে পরিবর্তন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে প্রত্যেক গ্রাহক সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন। এটি উত্তোলন করা যাবে শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে, এবং সুবিধাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আমানতকারীদের জন্য প্রযোজ্য। সূত্র মতে, একীভূত পাঁচ ব্যাংকে একই জাতীয় পরিচয়পত্রে একাধিক হিসাব পরিচালনার ঘটনা দেখা গেছে। তাই ঝুঁকি কমাতে প্রাথমিক পর্যায়ে একটি পরিচয়পত্রযুক্ত একটিমাত্র হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “একীভূত ব্যাংকের প্রাথমিক কার্যক্রম দ্রুত এগোচ্ছে। নির্ধারিত সময়েই গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারবেন। তবে সব শাখায় একই দিনে টাকা বিতরণ শুরু হবে না। ধাপে ধাপে প্রতিদিন বিভিন্ন শাখা থেকে অর্থ প্রদান করা হবে। আমরা চাই না গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে ভিড় জমান। সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকে আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ।”

