নীতি–সহায়তার আড়ালে খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর লুকানো বিপুল খেলাপি ঋণ প্রকাশ্যে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই অঘোষিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছায়। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে তৎপরতা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো ১৪ হাজার ৬৫২টি মামলা করেছে। এখন মামলায় ঝুলে আছে মোট চার লাখ সাত হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।
জুন শেষে অর্থঋণ আদালতে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ২২ হাজার ৩৪১টি, যার বিপরীতে আটকে আছে ৪ লাখ ৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। মার্চ শেষে মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৩টি এবং সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এসব তথ্য গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকার্স সভায় উপস্থাপন করা হয়। সভায় গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকগুলোকে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।
ঋণ আদায়ে চাপ বাড়ায় মামলা বেড়েছে:
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণ আদায়ে চাপ বাড়ায় ব্যাংকগুলো আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি মামলা করেছে। বিগত সরকারের সময়ে প্রভাবশালী হিসেবে বিবেচিত অনেক বড় ঋণগ্রহীতা এখন পলাতক বা কারাগারে। ফলে স্বল্প সময়ে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ আদায়ের মামলা করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা বাড়িয়ে চলতি বছর সাতটিতে উন্নীত করা হয়েছে, যা আগে ছিল চারটি।
নিষ্পত্তি ও আদায়ের অগ্রগতি:
এপ্রিল–জুন সময়ে ১১ হাজার ৯৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এবং আদায় হয়েছে ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। একই সময়ে নতুন করে ১৪ হাজার ৬৫২টি মামলা করা হয়, যার বিপরীতে জড়িত অর্থ ৯৬ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে নিষ্পত্তি হয়েছিল ১০ হাজার ৬৪টি মামলা এবং আদায় হয়েছিল ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ জুন প্রান্তিকে মার্চের তুলনায় ১ হাজার ৮৮০টি মামলা বেশি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং আদায় বেড়েছে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ আদায়ের বড় বাধা হিসেবে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার অর্থঋণ আদালত আইনে কঠোরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রস্তাবিত পরিবর্তন অনুযায়ী—ঋণগ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তি ছাড়াও নামে–বেনামে থাকা দেশি–বিদেশি সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায় করা হবে।
অর্থঋণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে অনাদায়ী ঋণের ৫০ শতাংশ জমা দিতে হবে। রায় রিভিউ করতে চাইলে দিতে হবে ৭৫ শতাংশ। ঋণখেলাপির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ আরও বেশ কিছু ধারা যুক্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিপুল আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। এ পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকের উদ্যোগ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে করা রিটগুলো দ্রুত শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তির আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকালের সভায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছর মেয়াদে বিশেষ পুনঃতপশিল নীতির অগ্রগতি নিয়েও প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। সেখানে জানা যায়—পাঁচ সদস্যের কমিটির কাছে পুনঃতপশিল চেয়ে এসেছে ১ হাজার ৫১৬টি আবেদন।
এসব আবেদনের বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ ব্যবসায়ী গ্রুপের আবেদনই ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩০০ ব্যবসায়ীর ৯০০ আবেদন নিষ্পত্তি করেছে।
ব্যাংকগুলো ২৫০টি আবেদনের বিপরীতে ২৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল করেছে। বাকি আবেদনগুলোতে ব্যাংকগুলোর সাড়া নেই।

