বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের বড় অংশ ছোট সংখ্যক বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। গত জুন পর্যন্ত শীর্ষ ৫০ শিল্প গ্রুপের ফান্ডেড ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায়। নন-ফান্ডেড ঋণ যুক্ত করলে সংখ্যা আরও বেশি। বিপুল ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি রয়েছে মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের এক চতুর্থাংশেরও কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা মনে করছে, ঋণ এইভাবে কেন্দ্রীভূত হওয়া দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের বিষয়। বড় কোনো ঋণগ্রহীতার ব্যর্থতা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ শিল্প গ্রুপসহ ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণকে ‘বৃহৎ ঋণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত জুন পর্যন্ত এই ধরনের ঋণ রয়েছে ১০ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৬২.৫৯ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৭৭ শতাংশও বড় ঋণগ্রহীতাদের হাতে আটকে আছে। বিপজ্জনক বিষয় হলো, এই ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, যা ২৭.১১ শতাংশ। ফলে বড় ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে শিল্প গ্রুপগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি। নন-ফান্ডেড ঋণের পরিমাণও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনটি গতকাল ব্যাংকার্স সভায় উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অল্পসংখ্যক ঋণগ্রহীতার হাতে ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগ তৈরি করছে। এক বড় ঋণগ্রহীতার ব্যর্থতা ‘সংক্রমণ ঝুঁকি’ তৈরি করতে পারে। বড় ঋণ অনাদায়ী হলে একাধিক ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়বে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সমপরিমাণ একক ব্যক্তি বা গ্রুপকে ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণ সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ, নন-ফান্ডেড ঋণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। তবে বাস্তবে বড় ঋণে এই নিয়ম অনেক ক্ষেত্রে অমান্য হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে অনেক ব্যাংকের ঋণ বিতরণ প্রভাব খাটিয়ে একক ব্যবসায়ী গ্রুপের নামে করা হয়। ভুয়া জামানত বা একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত একটি ব্যাংক ১০০ টাকা বন্ধকি সম্পত্তির বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা ঋণ দিতে পারে। অনেক ব্যাংক নিজস্ব নীতিমালায় এর চেয়ে বেশি জামানত নিতেও বাধ্য ছিল। কিছু ব্যাংক ১০০ টাকা ঋণের বিপরীতে ২০০ টাকার জামানত চাইত। আবার কেউ ১২৫ টাকার জামানতের বিপরীতে ১০০ টাকা ঋণ দিত। তবে এসব নিয়ম অমান্য করে নামসর্বস্ব কোম্পানি তৈরি করে বড় ঋণ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বড় ঋণগ্রহীতারাও ঋণ নেওয়ার সময় নিয়ম মেনেই জামানত দেখিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধক সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখানো হয়েছে। অনেক কেসে কেবল কাগজ তৈরি করে জামানত দেখানো হয়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে অনেক পলাতক, কেউ কেউ জেলে রয়েছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকগুলো আসল চিত্র সামনে আনতে শুরু করেছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাতারাতি এসব ঋণ সৃষ্টি হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক দখল বা প্রভাব প্রয়োগ করে ঋণ নেওয়া হয়েছে। কখনও জামানত ছাড়া, কখনও স্বল্প বা ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সবই হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিগ্রাহ্য অঞ্চলে। তিনি বলেন, “আগামীতে যাতে এ ধরনের সুযোগ না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে এসব ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।”

